গত সংখ্যার পর
সামাজিক বিভেদের খড়্গ মানবিকতাকে ফালাফালা করে দিল নিশ্চিত রূপে। আনন্দময়ী নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আত্মসংযমী হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে।পারিবারিক পরম্পরায় ফিরে আরও বেশি অন্তর্মুখী হয়ে উঠলো নিরীহ মেয়েটি।
কিছুদিন পর ঘটক ও আত্মীয়দের মাধ্যমে পাত্রের সন্ধান মিলল।পুরানো জমিদার বাড়ির ছেলে অভয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মহা ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল আনন্দময়ীর। ভালো ঘর ও বর পেয়েও আনন্দময়ী নির্বিকার, নিরাসক্ত। নিজের বাপের বাড়ি ও শশুরবাড়ির সম্মান রক্ষায় আরও বেশি করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে পূজা আর্চায় ডুবে গেল সে। কুলদেবতার নিত্যসেবা ও ভোগ রান্নায় ক্রমশ জড়িয়ে নিল নিজেকে। মাঝে মাঝে বুকের মাঝে হাহাকার ধ্বনি ওঠে তার। কে শুনবে, কে বুঝবে তার ব্যাথা বেদনার কথা? মাঝে মাঝে মা বাবা হারানোর বিয়োগ ব্যাথা তাকে আরও বিধ্বস্ত করে তোলে। মনের মধ্যে তীব্র ঝড় বয়ে যায়। নিজের ঘরে বালিশ চাপা দিয়ে শুধু ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। ঠাকুরের নাম স্মরণ করতে করতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়ে। কিছুদিন পরই তাকে তার প্রানপ্রিয় ঘর, আত্মীয় পরিজন ও তার আরাধ্য কুলদেবতা ছেড়ে আসতে হলো অনিবার্য ভাবে। নতুন অচেনা গ্ৰামের দূর সম্পর্কের আত্মীয় বাড়িতে ঠাঁই হল তার।
মন্দির থেকে ফিরে এসে বড় জ্যাঠাইমার হাতে প্রসাদের রেকাবী তুলে দিল সে। গোটা বারান্দা জুড়ে সুর করে পড়াশোনা করছে এ বাড়ির কচিকাঁচার দল। কলতলায় হাত পা ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল আনন্দময়ী। কিছুক্ষণ পরেই পোশাক বদলে রান্নাঘরে এলো। সামান্য কাজ কিম্বা ফাই ফরমাস খাটলেও অবাধ পদচারণায় আছে লক্ষ্মণের বেড়ি। ব্রাম্হণ বাড়ির বিধবা যে! অনেক কিছু মেপে চলতে হয় তাকে। পরিবারের অনেকেই বাইরে থাকে। তাদের ছেলেমেয়ে, বৌ- ঝিদের ক্ষেত্রে উদারতা লক্ষ্য করে আনন্দময়ী। তাকে এতো নিয়মকানুন করতে দেখে তারা একটু সোচ্চার হলেও বড় জ্যাঠাইমা আর ছোট পিসিমার চোখ রাঙানিতে কেঁচো হয়ে যায় উদারতা আর আধুনিকতার মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষগুলো। মোটকথা এ বাড়িতেও থাকা খাওয়ার স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছু মেলে না। তবে এক জায়গায় আনন্দময়ীর ঢালাও স্বাধীনতা আছে। চন্ডীমন্ডপে অলস দুপুরে রামায়ণ, মহাভারত কিম্বা পাঁচালি পাঠে তার সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। অবশ্য এই কাজ মন্দ লাগেনি আনন্দময়ীর। মাঝে মাঝে বাড়ির কচিকাঁচাদের আদর আবদার, দস্যিপনা সামলাতে হয় তাকে। এ বাড়ির নিয়মকানুন কিম্বা অনুশাসনের রাশ আর একজনের হাতে রয়েছে। তিনি হলেন ছোট তরফের অন্যতম কর্তা হরিহর চাটুয্যে। বড় ও মেজো তরফের অধিকাংশই থাকে বাইরে। তারা ফি বছর গ্ৰামে আসে দুর্গা,কালী পূজা সহ অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানে। কয়েকটি দিন মেতে ওঠে গোটা গ্ৰাম। বংশপরম্পরায় চাটুয্যে বাড়ির এই উৎসবকে ঘিরে পাশাপাশি গ্ৰামের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। উৎসব অনুষ্ঠান ও কুলদেবতার নিত্য সেবা কাজের জন্য জমি পুকুর বিলি বন্দোবস্ত করা আছে। চাষ জমি থেকে ফলের বাগান, পুকুরে মাছ চাষ সহ সমস্ত কাজ তদারকি করেন হরিহর নিজে। তিনি দু’বেলাই আসেন বড় তরফের খোঁজ খবর নিতে। তদ্বির তদারকি করেন সব কাজে। চাটুয্যে মশাইয়ের সঙ্গে আজ মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় আনন্দময়ীর। খিড়কি পুকুর থেকে ঠাকুর মন্দিরের বাসনকোসন ধূয়ে সিঁড়ি ভেঙে আসার সময় দেখে হরিহর বাবু চালতা আর জামরুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন। হনহন করে পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় হরিহর বাবু বলে ওঠেন- এবার একটু স্বাভাবিক হও গো দিদিমনি! কি ভালো লাগছে তো আমাদের গ্ৰামখানি? ক্ষণিক থেমে একটুখানি স্মিত হেসে আনন্দময়ী নিচু গলায় বলে- খুউব ভালো লাগছে দাদামশাই। তার মায়ের এক সম্পর্কে মামা হন তিনি। আনন্দময়ীর দাদু বা দাদা মশাই হচ্ছেন সম্পর্কে। তাঁরই বদান্যতায় একটা হিল্লে হয়েছে আনন্দময়ীর। একদিক দিয়ে তার সামাজিক নিরাপত্তা ও সংস্কারের বেড়াজালে দিন কাটানোর বন্দোবস্ত হয়েছে। এই জীবন কি চেয়েছিল সে? তারও স্বপ্ন ছিল সুখীগৃহকোন গড়ে তোলার।
স্বামী, সন্তান আর শশুর বাড়িতে আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাসা বেঁধেছিল তার মনে। আজ সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। আজ নিজেকে সমাজের গলগ্ৰহ ছাড়া আর কিছু ভাবে না আনন্দময়ী। তার বাবা তাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসতেন বলেই নাম রেখেছিলেন- আনন্দময়ী। সেই আনন্দময় জীবনের অধিকারিনী এক যুবতী সমাজ জীবনের কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে গেল অকাল বৈধব্যের কারনেই। নির্মম সত্যি কথাটা আনন্দময়ী জেনে গেছে তার অতি প্রিয় শরৎ সাহিত্য পড়ে। যেখানে শুধু নিয়মতান্ত্রিকতাই নয়, তার বেড়ি ভাঙার নিদানও আছে। বহু কষ্ট, বহু ত্যাগ স্বীকার করেছেন অবলা বান্ধব বিদ্যাসাগর মশাই। তিনি সংস্কৃত শাস্ত্র খুঁড়ে অক্ষতযোনী বিশিষ্ট অকাল বিধবার বিয়ের বিধান খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই দেড়শো বছরের আলোময় পথ জমাট বাঁধা অন্ধকারে ডুবে আছে আজও। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পল্লী বাঙলার উত্তরণ ঘটেনি আজও। মানবতার জয় হয়নি এখানে। শিক্ষার প্রগতি ডুবে আছে খানা ডোবায়,পানা পুকুরে।
বাঙালির সমাজ জীবনের চর্যা পথের পদাবলী আজও গভীর রেখাপাত করে ব্যাক্তি ও পারিবারিক জীবনে। যে জীবন আজ শুধু থমকে আছে সমাজের ঠুনকো বিধানের হাঁড়ি কাঠে সেখানে নারীবাদ আজ ভূলুণ্ঠিত। একমাত্র সহজিয়া জীবন শুধু গাইতে পারে মানবতার গান আর চর্যাপথের পদাবলী।
(চলবে)