ঘড়ির সময় অনুযায়ী ৭০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্যভবনের সামনে একটানা অবস্থান করে যাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁরা নিজেদের দাবিতে অনড়, তাদের দাবি না মেটা পর্যন্ত যে তাঁরা তাঁদের অবস্থান থেকে একপা নড়বেন না সেকথা তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এমনকি নবান্নের সভাকক্ষের সামনে পৌঁছেও তাঁরা যে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন নি তারও কারণ তাঁরা সরাসরি সম্প্রচার চেয়েছিলেন কিন্তু রাজ্য প্রশাসন তাতে রাজি না হওয়ায় তাঁরা আলোচনায় সম্মত হননি। ফিরে এসেছেন সবাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থানে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে এবার কী পদক্ষেপ করবেন আন্দোলনকারীরা? কবে কর্মবিরতি কাটিয়ে ফের কাজে ফিরবেন, সেদিকে তাকিয়ে রাজ্যবাসী। তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি ও আন্দোলন চলবে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে ছিল আরজি কর মামলার শুনানি। সেই শুনানিতেই শীর্ষ আদালত ১০ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে যোগ দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু সেই সময়সীমাও পেরিয়ে গিয়ে ৬৫ ঘণ্টা অতিক্রান্ত। জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি তোলেননি বরং তাঁরা তাঁদের আন্দোলনকে নতুন অভিমুখে নিয়ে গিয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, জুনিয়র ডাক্তারেরা কি তবে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ‘অবমাননা’ করছেন? এ বিষয়ে বিভিন্ন আইনজীবীরা যে মতামত দিচ্ছেন তা থেকেও ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ স্পষ্ট হচ্ছেনা বরং জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রসঙ্গত, এই আলোচনায় দু’জন অভিজ্ঞ আইনজীবীর কথা উল্লেখ করা যায়। একজন হলেন তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সিপিএমের বিকাশ ভট্টাচার্য।
জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি চালিয়ে গিয়ে কি আদালত অবমাননা করেছেন? এই প্রশ্নে তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন,“আদালত অবমাননা না হলেও জুনিয়র ডাক্তারেরা কাজে যোগ না দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টকে ‘অসম্মান’ করা হয়েছে। তিনি এও বলেন, জুনিয়র ডাক্তারেরা সুপ্রিম কোর্টকে কাঁচকলা দেখিয়েছেন। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, রাজ্য সরকার সহনশীলতা দেখাচ্ছে’। তিনি আরও বলেন, “সরকার এতটা সহনশীল না হলেও পারে। কারণ, গরিব মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।”অন্যদিকে বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, “যাঁরা বলছেন আদালত আবমাননা হচ্ছে, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ না জেনেই বলছেন। সুপ্রিম কোর্ট কোথাও বলেনি, ১০ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে যোগ দিতেই হবে। আদালত বলেছিল, জুনিয়র ডাক্তারেরা ১০ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টার মধ্যে কাজে যোগ না দিলে রাজ্য সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে চাইলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।”এরপরেই কল্যাণ বলেন, “এটাকে আদালত অবমাননা বলা যায় না। তবে নিশ্চিত ভাবেই বিচার ব্যবস্থার যে কাঠামো রয়েছে, তাতে সুপ্রিম কোর্টকে অসম্মান বা অপমান করা হয়েছে।” এই দুই আইনজীবীর বক্তব্যের পাশাপাশি কলকাতা হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দেবাশিস কর গুপ্তের আইনি ব্যাখ্যা, “আদালত অবমাননা হয়েছে কি হয়নি, সেটা আদালতের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চই নির্ধারিত করবে। এটা অন্য কেউ নির্ধারিত করতে পারেন না।”
প্রসঙ্গত, আদালত অবমাননা বিষয়টি একটু জেনে বুঝে নেওয়ার দরকার পড়ে। আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টগুলি সংবিধানের ১২৯ এবং ২১৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে অবমাননার শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যে কাজগুলির জন্য আদালত কাউকে শাস্তি দিতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হল যে কাজ আদালতকে কলঙ্কিত করে, আদালতের কর্তৃত্ব হ্রাস করে, যে কার্যক্রম চলতে থাকা বিচারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে বা বিচার প্রশাসনের উপর হস্তক্ষেপ করে। অন্যদিক থেকে আদালতের আদেশ অমান্য করা, আদালতের কার্যক্রমকে বাধা দেওয়া, বা আদালতের মর্যাদাকে প্রভাবিত করে এমন বক্তব্যও আদালত অবমাননার মধ্যে পড়ে। ১৯৭১ সালের কনটেম্পট অব কোর্টস অ্যাক্ট অনুযায়ী, আদালত অবমনানর সাজা সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড, জরিমানা, অথবা সাজা ও জরিমানা দুটোই। আদালত এই জেল-জরিমানা মকুব করে দিতে পারে, যদি আদালত অবমাননাকারী আদালতে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেক্ষেত্রেও আইনে বলা রয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট স্থির করবে, সেই ক্ষমাপ্রার্থনা যথেষ্ট কি না।
আইন মন্ত্রক সূত্র এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের অবমাননা হলে আদালত প্রথমে জবাবদিহি চাইবে। এরপর সন্তোষজনক জবাব না পেলে সাজা ঘোষণা করা হবে। আইন মন্ত্রকের একটি সূত্র জানাচ্ছে, আইনসভা, প্রশাসন এবং বিচারবিভাগ—এই প্রতিটি ব্যবস্থাই সংবিধান নির্মিত রাষ্ট্রনীতি। সেখানে কারণ না দর্শিয়ে খোদ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করার অর্থ, সংবিধান নির্ধারিত রাষ্ট্রনীতিকেই অগ্রাহ্য করা। আইন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সংবিধানের ১২৯ এবং ১৪২ ধারায় আদালতের অবমাননা ধার্য করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের হাতেই এই ধারায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে।
তবে কোন বিষয় আদালতের কর্তৃত্বকে খাটো করে বা আদৌ করে কি না সে বিষয়ে অলোক প্রসন্ন কুমার ২০১৬ সালে তাঁর ব্যাখ্যায় বলেন, আদালত অবমাননা আইন, ১৯৭১-এর ধারা ২(সি) এ “ফৌজদারী অবমাননা” গঠনের জন্য আইনি পরীক্ষা নির্ধারণ করা হয়েছে যে কোনো প্রকাশনা যা আদালতকে খাটো করে বা কোনো আদালতের কর্তৃত্বকে হ্রাস করে। এগুলি বিস্তৃত এবং সাধারণ পদ, তবে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করেছে যে রায়ের ন্যায্য সমালোচনা সর্বদা অনুমোদিত এবং বিচারকের মানহানি আদালত অবমাননার থেকে আলাদা। (ব্রহ্ম প্রকাশ শর্মা বনাম উত্তর প্রদেশ রাজ্য ১৯৫৩: প্যারাস ১২-১৩)। পাশাপাশি আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে যে চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া মামলার যোগ্যতার উপর “ন্যায্য সমালোচনা” বা “ন্যায্য মন্তব্য” অবমাননার সমান হবে না। কিন্তু কোনটা “ন্যায্য” সেটা বিচারকদের ব্যাখ্যার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।