জার্মানি যেসব দেশ দখল করেছিল, সেসব দেশে ব্রিটিশ সরকার স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ সংস্থার গুপ্তচর পাঠাতো। উদ্দেশ্য সেসব দেশে যারা নাৎসি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদের সাহায্য করা। একই উদ্দেশ্যে এসওই থেকে এক মহিলা গুপ্তচরকে পাঠানো হয়েছিল প্যারিসে। ধারণা করা হয় তিনিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে কাজ করা প্রথম গুপ্তচর। যদিও তাঁর ফ্রান্স যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল এসওই-র হয়ে রেডিও অপারেটরের কাজ করা। ফ্রান্সের খবর হেডোকোয়ার্টারে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার দায়িত্ব ছিল তাঁর। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কারণ, প্রতি এক-দেড় মাসে এসওই-র কোনো না কোনো রেডিও অপারেটর ধরা পড়ত। এতকিছু জেনেও সংগঠনটির রেডিও অপারেটর হিসেবে কাজের দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন যিনি তাঁর নাম নুর ইনায়েত খান।

পরিকল্পনামতো দুটি প্লেন অবতরণ করে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ১৯০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের অ্যাঙ্গার্স শহরে। সেখান থেকে সাইকেলে করে রাতের আঁধারে নূর চলে যান ট্রেন স্টেশন, তার কাজের জায়গা প্যারিসে, যেকোনো এজেন্টের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকা। ইংল্যান্ডে তিনি যোগ দিয়েছিলেন উইমেনস অক্সিলিয়ারি এয়ার ফোর্স-এ একজন রেডিও অপারেটর হিসেবে। পরবর্তীতে এসওই-তে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। তাঁকে ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি অকপটেই স্বীকার করেছিলেন, এখন তিনি ব্রিটিশদের হয়েই লড়বেন, তবে যুদ্ধ শেষ হলে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্যই লড়বেন। শুরুতে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁকে নিয়ে ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না, কারণ তিনি সরাসরিই নিজের আদর্শের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। তবে কর্মক্ষেত্রে নিজের পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ রেখে নূর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সন্দেহ দূর করে দেন।

এক ব্রিটিশ অফিসারের সঙ্গে আংটি বদলও করেছিলেন কিন্তু জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়বার ইচ্ছা অতিক্রম করেছিল ভালবাসার টানও। তাই পশ্চিম সাসেক্সের রয়্যাল এয়ার ফোর্সের ট্যাংমেয়ার এয়ার ফিল্ডে লাইস্যান্ডার বিমানে চড়ে বসেন তিনি। পিছনে রেখে যান ভালবাসার মানুষটিকে। এগিয়ে যান অক্ষশক্তির কালো থাবার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দৃঢ় প্রত্যয়ে। প্যারিসে পৌঁছে নূর যোগ দেন সিনেমা সার্কিটে, যাদের কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল প্যারিসের বাইরেও। ভার্সাইয়ের এক কৃষি কলেজ থেকে তিনি এসওই-র হয়ে প্রথমবার রেডিও ট্রান্সমিশনের কাজ করেন। তখন অনেক এজেন্ট জার্মানদের হাতে ধরা পড়ছিল। এমনকি তারা ফিরে এসেছিল সেই কৃষি কলেজে। সৌভাগ্যক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি। লন্ডনে জানিয়ে দেন দূরবস্থার কথাও। এসওই থেকে নূরকে ফেরত আসার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু তিনি ফিরে যেতে রাজি হন নি। একসময় তিনিই হন প্যারিসে থাকা এসওই-র একমাত্র রেডিও অপারেটর। অন্য সবাই ততদিনে ধরা পড়ে গিয়েছে। নূর তাঁর পক্ষে যা যা করা সম্ভব সবই করছিলেন। অন্য এজেন্টদের প্রয়োজনীয় খবর পৌঁছে দেওয়া, প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা এমনকি যুদ্ধাহত পাইলটদের দেশে ফেরার ব্যবস্থাও তিনি করছিলেন। কেবল তিনি নিজেই দেশে ফেরার চিন্তা মাথায় আনেননি।

জার্মানদের হাতে ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে নূর নিয়মিতই স্থান বদলাতেন। সেজন্য নিজের রেডিও ট্রান্সমিশনের যন্ত্রপাতিগুলি একটি ব্যাগে নিয়ে ঘুরতেন। একবার দুই জার্মান সেনা এসে সরাসরিই ব্যাগ খুলে দেখতে চাইল। নূরও কোনো রকম দ্বিধা না করে ব্যাগ খুলে দিয়ে বললেন, ভেতরে রাখা আছে সিনেমাটোগ্রাফির যন্ত্রপাতি। এরপর সেটা কীভাবে কাজ করে সেটাও তাদেরকে বোঝাতে লাগলেন। তাঁর কাছ থেকে সেসব শুনে সেনারা আর কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। খুশিমনেই চলে যায় তারা, নূরও হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। আরেকবার তিনি ট্রান্সমিশনের জন্য এক গাছে চড়ে এন্টেনা ঠিক করছিলেন। এমন সময় এক জার্মান সেনা এসে তাঁকে সাহায্য করতে চায়। নূর তাতে সায় দিলে সৈনিকটি তাঁকে সাহায্য করে চলে যায়। যাবার সময় সৈনিকটি জানত, সে এক সঙ্গীতপ্রেমী মহিলাকে রেডিও শুনতে সাহায্য করেছে! ওদিকে নূরের কার্যসিদ্ধি হয়ে যায়। কিন্তু এভাবে আর খুব বেশি দিন চললো না। গেস্টাপো (গেহেইম স্টাট্সপোলিজেই, অর্থাৎ গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী, নাৎসি জার্মানি এবং জার্মানি অধিকৃত ইউরোপে কর্মরত গোপন পুলিশ বাহিনী) নূরের সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। তাই তাঁকে ধরিয়ে দিলে ১,০০,০০০ ফ্রাঁ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফেরত আসার ঠিক আগের রাতেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। গেস্টাপোর সদস্যরা তার অবস্থান সম্পর্কে জেনে যাওয়ায় গোপনে তাঁর বাড়িতে ঢুকেনূরকে আটক করে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় প্যারিসে গেস্টাপোর সদরদপ্তরে। সেখানে তিনি আলাদা বাথরুমে স্নানের অনুমতি চাইলে তা দেওয়া হয়। বাথরুমের জানালা খুলে পাঁচতলা বেয়ে নামা শুরুও করে দিয়েছিলেন কিন্তু ভাগ্য খারাপ, পাশের ঘরের এক গেস্টাপো সদস্য তাঁকে দেখে ফেললে আবার তাঁকে আটক করা হয়। বন্দী থাকাকালীন জন স্টার নামক এক ইংরেজ এবং লিওন ফায়ে নামক এক ফরাসি এজেন্টের সাথে পরিচয় হয় নূরের। তিনি তাদের পালানোর প্রস্তাব দিলে তারা রাজিও হয়ে যায়। একটি স্ক্রু ড্রাইভার চুরি করে আনেন স্টার। এক রাতে সেটা দিয়েই একে একে তিনজন জানালার শিক খুলে পালানোর ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেকেই সঙ্গে নিয়েছিলেন কম্বল, যাতে সেটা দড়ির মতো করে পেঁচিয়ে নিচে নামা যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই রাতেই প্যারিসে আক্রমণ চালায় রয়্যাল এয়ার ফোর্স। ফলে তাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, ধরা পড়েন তিনজনই। বন্দীশালার প্রধান তাদের প্রথমে গুলি করে হত্যার হুমকি দিলেও পরে প্রস্তাব দেন যেন তারা লিখিতভাবে আর না পালানোর অঙ্গীকার করেন । স্টার সাক্ষর করলেও নূর এবং ফায়ে করেন না। এর কিছুদিন পর নূর আবার জেলখানা থেকে পালানোর চেষ্টা করেন, সফল হন, আবার ধরা পড়ে যান! এবার আর তাকে প্যারিসে রাখা নিরাপদ মনে করেনি কর্তৃপক্ষ। তাকে সোজা পাঠিয়ে দেওয়া হয় জার্মানিতে। সেখানে একেবারে শিকল পরিয়েই রাখা হয়েছিল তাকে। ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে এক ভোরবেলায় ঘাড়ের পেছন দিকে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় নূর ইনায়াত খানের। মৃত্যুর আগে তার শেষ কথা ছিল, “Liberté” যার অর্থ স্বাধীনতা।
