তিন হাজার তিনশো ফুট উঁচু মালভূমিতে তুরস্কের আনাতোলিয়ার কাপাদোসিয়া এলাকাটি ছিল অগ্নুৎপাতের জন্য বিখ্যাত। কয়েক মিলিয়ন বছর আগে সেই এলাকায় অগ্ন্যুৎপাতে এলাকাটি ছাই আর লাভায় ডুবে গিয়েছিল। সেই ছাই আর লাভা পরবর্তীতে পাথরে পরিণত হয়। প্রাচীন অধিবাসীরা বুঝতে পেরেছিল, ওই পাথর নরম হওয়ায় তা দিয়ে ঘর বাড়ি তৈরি করা সম্ভব। ফলে তারা সেই নরম পাথর দিয়ে ঘরবাড়ি বানিয়ে মাটির নিচে একটি শহর বানিয়ে ফেলে। তবে ঠিক কারা কোন সময়ে এই শহরটি বানিয়েছিলেন তা সঠিক জানা যায়নি। অনুমান খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১২০০ অব্দে আনাতোলিয়ায় ছিল ‘হিত্তিতি’দের রাজত্ব। এরপর নানা দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের ফলে হিত্তিতি সাম্রাজ্য ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর এই এলাকায় বলকান থেকে ‘ফ্রিজিয়ান’দের আগমন ঘটে। কেউ কেউ ধারণা করেন, ফ্রিজিয়ানদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্যই হিত্তিতিরা এই শহর নির্মাণ করেছিল।

১৯৬৩ সালে তুরস্কের নেভশেহির প্রদেশে এক ভদ্রলোক নিজের বাড়ি মেরামত করাকালীন হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ে দেয়াল, ধ্বসে যায় মেঝে। তিনি নিজেকে আবিস্কার করেন মাটির নিচের অন্ধকার এক ঘরে। সেই ঘরের দরজার দিকে যেতেই তিনি দেখতে পান দরজার ওপারের অন্ধকারে রয়েছে অজানা এক গহ্বর। সেই গহ্বরের দিকে এগতেই তিনি দেখতে পান মানব সভ্যতার এক রহস্যময় শহরের প্রবেশদ্বার। তিনি স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর পরেই রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। পরে দেখা যায়, জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই ছিল ওই শহরে। যেমন স্কুল, গীর্জা, বাজার, গোয়ালঘর, কুয়ো, জমায়েতের জায়গা, এমনকি অস্ত্র জমা রাখার ঘরও ছিল। ভূগর্ভস্থ শহরটিতে ছিল খাবারের দোকান, মদের ভান্ডার এবং কবরস্থান। এই শহরের নাম ডেরিংকুয়ো। এই শহরকে বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভূগর্ভস্থ শহর। পরিকল্পিত এই শহরটিতে আনুমানিক ২০ হাজার লোক বসবাস করতেন।

ইতিহাসে লিখিতভাবে কাপাদোসিয়ার এসব ভূগর্ভস্থ শহরের কথা সর্বপ্রথম দেখতে পাওয়া যায় গ্রীক সেনা ও ইতিহাসবিদ জেনোফোনের লেখায়। তিনি বহুকাল ধরে এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। তার লেখা ‘অ্যানাবেসিস’ নামক বইতে তিনি লিখেছেন, “এখানকার ঘরগুলি ছিল মাটির নিচে। ঘরে ঢোকার মুখ কুয়োর মতো হলেও ছিল যথেষ্ট প্রশস্ত। গবাদিপশুর যাতায়াতের জন্য ছিল সুড়ঙ্গ। তবে মানুষ যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতো সিঁড়ি। ঘরগুলিতে ছাগল, ভেড়া, বাছুর সহ বিভিন্ন ধরনের পাখি পোষা হত এবং প্রতিটি ঘরেই এদের সবার খাবারের ব্যবস্থা ছিল”।গবেষকদের মতে কাপাদোসিয়াতে ভূগর্ভস্থ শহরের সংখ্যা প্রায় হাজারের কাছাকাছি। এদের মধ্যে সবচেয়ে গভীর ডেরিংকুয়ো। মাটির নিচের এই শহরের খনন কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। আঠারোটি স্তর বিশিষ্ট এই শহরের মাত্র আটটি স্তর এখন দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।

শহরের তলদেশ দিয়ে একটি নদীর প্রবাহ ছিল। গোটা শহরজুড়ে তৈরি করা হয়েছিল অনেকগুলি কুয়ো। সেই কুয়াগুলি ওই নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। রোজকার পানীয় জল কুয়ো থেকেই সংগ্রহ করা হত। আশ্রয়স্থল কিংবা বাসস্থানের থেকেও বেশি কিছু ছিল এই ডেরিংকুয়ো। এটি ছিল একটি দুর্গের মতো। শত্রুর আক্রমণে শহরবাসী যখন মাটির নিচের এই শহরে আশ্রয় নিত, তখনো এলাকার ব্যবসা বাণিজ্য কিংবা অন্যান্য কাজকর্ম থেমে থাকতো না। জমায়েতের জন্য স্থান, মুদির দোকান, বিশাল খাবারের জায়গা এমনকি সম্পূর্ণ বাজারও ছিল এই মাটির নিচের শহরে! অস্ত্রাগারে সবসময় জমা থাকতো অস্ত্র। আর যেকোনো সময়ে এই শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ারও অনেক ব্যবস্থা ছিল এখানে। অন্য যেকোনো ভূগর্ভস্থ শহরের থেকে ডেরিংকুয়ো ছিল আলাদা। সব দিক দিয়ে এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ শহর সেই সময় খুব কমই ছিল।

খারাপ আবহাওয়া থেকেও সুরক্ষা দিতে এই ডেরিংকুয়ো। প্রচন্ড গরম কিংবা তীব্র ঠান্ডা ও তুষারপাতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতো এই শহর। উপরে যখন তীব্র গরম কিংবা শীত, নিচের এই শহরে তখন আরামদায়ক আবহাওয়া। ফলে পশুপাখি কিংবা খাদ্যদ্রব্য খুব সহজে সংরক্ষণ করা যেত এই শহরে।মাটির নিচের রহস্যময় শহর ডেরিংকুয়ো ১৯৬৯ সাল থেকে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, যদিও গোটা শহরের মাত্র ১০ ভাগ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আগত পর্যটকরা প্রতিনিয়ত মানব সভ্যতার এই অনন্য নিদর্শন দেখতে যান। মাটির নিচের এই শহরে প্রবেশ করলে আপনিও চলে যাবেন সেই হাজার বছর আগের এক নগরীতে। পাথুরে দেয়াল স্পর্শ করলে অনুভব করবেন গা শিরশিরে এক অনুভূতি, যা আপনাকে মনে করিয়ে দিবে হাজার হাজার বছর আগের এই শহরে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলোর কথা!
