প্রতি বছর বিশ্বে যত খাদ্য উৎপাদন হয়, তার এক তৃতীয়াংশই নষ্ট হয়। চাল, গম, ডাল থেকে শুরু করে শাক-সবজি, ফল, দুধ, মাছ-মাংস- সব মিলিয়ে বছরে ১৩০ কোটি টন নষ্ট হয় প্রতি বছর। এই ভয়ংকর তথ্য উঠে আসছে ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন বা ফাও-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট থেকে।
খাদ্য নষ্টের তালিকায় রয়েছে উন্নত, উন্নয়নশীল দেশগুলি। প্রতি বছর উন্নত দেশে খাদ্য নষ্ট হচ্ছে ৬৭ কোটি টন ও উন্নয়নশীল দেশে ৬৩ কোটি টন। যা অর্থের অঙ্কে ৬৮ হাজার কোটি ডলার এবং ৩১ হাজার কোটি ডলার।
আমাদের দেশের যে কোনো শহরের যে কোনও বাজারে গেলেই ছবিটা বোঝা যায়। প্রতিদিন সেখানে নষ্ট হওয়া ফল, শাক সবজির পরিমান কতটা তার আন্দাজ পাওয়া যায়। আসল পরিস্থিতিটা অবশ্য তার চেয়েও অনেক খারাপ। ফাও জানাচ্ছে, ৩০ শতাংশ দানাশষ্য, ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ আলু, পেঁয়াজ, গাজর, বিটের মতো মাটির নিচের সবজি এবং ফল ও অন্য সবজি, ২০ শতাংশ তৈলবিজ, মাংস, ও দুগ্ধজাত সামগ্রী ও ৩৫ শতাংশ মাছ নষ্ট হচ্ছে।
প্রতি বছর ধনী দেশগুলো ২২ কোটি টন খাবার নষ্ট করে, যা আফ্রিকায় দক্ষিণ সাহারার দেশগুলির মোট উৎপাদনের কাছাকাছি। যে পরিমাণ খাদ্য নষ্ট হয় তা বিশ্বে মোট যে খাদ্যশষ্য উৎপাদন হয় তার অর্ধেকের বেশি।
ভারতের যোজনা কমিশনের প্রাক্তন পরিকল্পনা বিশারদদের বক্তব্য, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কাছে সমস্যাটা হলো উৎপাদনের পর প্যাকেজিং, সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াকরণের। আর বিদেশে কৃষিজাত পণ্যের ভ্যালু এডিশন হয়, কারখানায় গিয়ে প্রসোসিং হয়, তারপর তা দোকানে পৌঁছয়, তাই দাম বেড়ে যায়। সে জন্য আর্থিক দিক থেকে ক্ষতির অঙ্কটা উন্নত দেশে বেশি। ওদের খাবার নষ্ট হওয়ার কারণ, বাজারে প্রচুর প্রসেসড খাবার আসে। তা কতদিনের মধ্যে খাওয়া নিরাপদ তার একটা তারিখ থাকে। অনেক সময় চাহিদা কমে গেলে তারিখ পেরিয়ে যায়, খাবার বিক্রি হয় না। নষ্ট হয়। আমাদের এখানে প্রক্রিয়াকরণের অভাবে, ঠিকমতো সংরক্ষণের অভাবে প্রচুর খাদ্য নষ্ট নয়।
ফাও জানাচ্ছে, ইউরোপ ও উত্তর অ্যামেরিকায় জনপ্রতি খাবার নষ্টের পরিমাণ ৯৫ থেকে ১১৫ কেজি। এটাই সাহারার দক্ষিণের দেশ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এসে কমে দাঁড়াচ্ছে ৬ থেকে ১১ কেজি। ধনী দেশগুলিতে লোকে বছরে ৯০০ কেজি খাবার খেয়ে থাকেন। আর গরিব অঞ্চলে বছরে জনপ্রতি উৎপাদন হয় ৪৬০ কেজি। উন্নয়নশীল দেশে শষ্য তুলে নেওয়ার পর ও প্রক্রিয়াকরণের সময় ৪০ শতাংশ ক্ষতি হয়। উন্নত দেশে ক্ষতি হয় বিক্রির সময় ও ক্রেতাদের হাতে খাবার আসার পর।
এই পরিমাণ খাদ্য নষ্ট নাহলে তা দিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে তিন মাস খাওয়ানো যেত। অথচ মাঠ থেকে শস্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে গুদামজাতকরণ এবং সেখান থেকে পরিবহন পর্যায়ে খাদ্যের অপচয় কমাতে সরকারের ছিল দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন কর্মসূচি। এই সব কর্মসূচিতে ফসল সংগ্রহ পর্যায়ে দুর্বলতার মতো বিষয় দূরীকরণকে অগ্রাধিকারগুলির মধ্যে রাখা হয়। এমন একটি পাইলট প্রকলল্প সাফল্যের মুখও দেখেছিল। কিন্তু, তাতে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এদিকে বারবার খাদ্য সংকটের হুঁশিয়ারি দিচ্ছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO বা ফাও)। এই বাস্তবতায়, জনগণকে সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের বিষয়ে সতর্ক করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে বিপুল অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না খাদ্য উৎপাদন। গত অর্থবছর নাগাদ- গত ১১ বছরে ধান ও গমের মতো প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১৩.৩৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯০ লাখ টনে। একই সময়ে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ১৪.৬৬% হারে। ফসলের মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত আসতে প্রতিবছর দেশে ৩৭ লাখ টনের বেশি খাবার নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে, বাড়িতে খাবার অপচয়ের বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ১.০৭ কোটি টন। বার্ষিক অপচয় ও নষ্টের মোট পরিমাণ ১ কোটি ৪৫ লাখ টন।