বসন্তের আগমনে সেই যে দিগন্তের কোলে কোলে আনন্দের ছবিটি দেখা দিয়ে হদয়দোলায় প্রথম দোলাটি দেয়, তারপর রাঙা অশোক-পলাশের হাসিরাশি আর শিরীষ-বকুল-আমের মুকুলের গন্ধে ভরা দক্ষিণ-হাওয়ায় মিলে মনটিতে কাঁপন ধরিয়ে তাকে করে উতলা, আর উপসংহারে দোলপূর্ণিমার ধূলায় ঘাসে ঘাসে হোলি খেলার দিনটি যেন হৃৎকমলে ধূম লাগিয়ে সেই আবেশকেই পৌঁছে দেয় উচ্ছ্বাসের শীর্ষে।
প্রেমে প্রাণে, গানে গন্ধে, ফুলে ফাগে, পিলু পরজে, পূর্ণচাঁদের প্রতীতিতে- এই দোলের দিনটি যেন বসন্তকে পরিয়ে দেয় তার পরমক্ষণের উষ্ণীশ, যার রত্নশোভার অবিসংবাদিত কোহিনুর হীরেটি অবশ্যই ‘রঙ’। যে রঙ জীবনেরই অচ্ছেদ্য অনুবন্ধী, তার উদযাপনের থেকে বড় উৎসব আর কীই বা হতে পারে? যে শূন্য ক্যানভাসটি নিয়ে জীবনের সূচনা, তাতে সবার প্রথমেই দুটি রঙ ভরতে শিখি ‘ঠিক’ আর ‘ভুল’-এর নামান্তরে – সাদা আর কালো। তারপর কালের যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের পটে এসে যোগ হতে থাকে কত, কত আরও রঙ- ধূসরের, আলোর, আঁধারের; স্বপ্নের, বাস্তবের; সুখের, শোকের, বিচ্ছেদের, মিলনের; ভালোবাসার; ঈর্ষার ; মধুর বেদনার, সুখের যাতনার; আনন্দের,…। এই এত অজস্র রঙ-ই না আমাদের অস্তিত্বকে দিয়েছে এত সৌন্দর্য্য, এত রোমাঞ্চ, এত যাপনসুখ!
আসন্ন রঙিন ফাগ-আবীরের দিনটিতে তাই সবার জন্য কামনা এই যে, জীবন হোক দোল-তিথিটিরই মতো বর্ণবৈচিত্র্য-মন্ডিত। আর, জীবনচালচিত্র-জোড়া যে বিপুল রঙের আয়োজন, তাতে আবহমান হোক আনকোরা, অচেনা, নবীন রঙেদেরও নিত্য আনাগোনা।
কেবল, আমাদের সবার মানবিকতার রঙ হোক একটিই – প্রেমের। কোনো বিভিন্নতা, কোনো অন্তর চাই না এই একটিমাত্র রঙে। সে রঙে লেখা ধর্ম-জাত-বর্ণের নাম হোক একটিই- ‘মানুষ’, সে রঙের গৌরবে আমাদের সবার হৃদয় হোক রঞ্জিত। এমনই এক দোল-পূর্ণিমা তিথিতে যে প্রেমের অবতার-পুরুষ নিবিড় অমা-তিমির ভেদ করে চাঁদের তরণী ভাসিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন নবদ্বীপের গঙ্গাতীরে, সেই শ্রীচৈতন্যের মানবতার অমোঘ বার্তাকে চেতনায় আত্মভূত করার প্রয়াসে প্রতিশ্রুত হতে পারতাম যদি আমরা, প্রেমের এই বসন্তদিনে?
মুখর হোক সকলের বসন্তোৎসব- বর্ণে-বর্ণান্তরে, ঐক্যে।
প্রণয়ে, বিরহে, বেদনায়, হর্ষে- শুভ হোক সবার রঙ-পার্বণ।