পাকিস্তানে নির্বাচনের পর দশ দিন পরেও নতুন সরকার গঠন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটলো না। সরকার গঠন ও নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়ে প্রায় প্রত্যেক দিনই নানা জল্পনা তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিনই পাকিস্তানে সরকার গঠন নিয়ে এক ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হছে, আবার সেই অবস্থা পাল্টে যাচ্ছে। অর্থাৎ, প্রতিদিন নিত্যনতুন সমীইরণের রাস্তা তৈরি হচ্ছে কিন্তু তা থেকে সমাধানের রাস্তা বেরচ্ছে না। ফলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, দেশটিকে কি হতে চলেছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানে এবারের নির্বাচনের ফলাফলে কোন দলই সংখ্যগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে ইমরান খানের দল পিটিআই সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা। অন্যদিকে দল হিসাবে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে নওয়াজ শরীফের দল পিএলএম-এন। তাদের পরেই আছে বিলওয়াল ভুট্টোর পিপিপি।
অনেকটা অভাবিত ভাবেই জোট সরকার গঠনের কথা শোনা গেল, নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ পিএমএল-এন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি- পিপিপি-এর মধ্যে। সেই সঙ্গে আরও জানা গেলো, দলীয় প্রধান নওয়াজ নয়, এই সরকারের প্রধান হতে যাচ্ছেন তার ভাই শাহবাজ শরীফ। অথচ দুদিন আগেও শাহবাজ ছিলেন আলোচনার বাইরে। নওয়াজ নয় তো বিলাওয়ালই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী হবার দৌড়ে। কিন্তু এই দুই দল জোট সরকার গঠনের উদ্যেগ নিলেও এখনও পর্যন্ত ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। নতুন সরকার গঠন করা নিয়ে পিএমএল-এন ও পিপিপি বেশ কয়েক দফা বৈঠক করলেও, ফলাফল এখন পর্যন্ত শূন্য। যদিও দুই পক্ষই দাবি করছেন, তাদের মধ্যে আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এর প্রধান কারণ, কিভাবে ক্ষমতা ভাগাভাগি হবে, তা নিয়ে কোনোভাবেই শরীফ এবং বিলওয়াল আপস রফা করে উঠতে পারছেন না। দু’পক্ষের মধ্যে পরপর হওয়া বৈঠকটিগুলি ছিল নিস্ফলা। আশা করা যায় উভয়ই ক্ষমতা ভাগাভাগির ফর্মুলা চূড়ান্ত করতে ফের বৈঠকে বসে সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন।
অন্যদিকে নিজের দলের নির্দল প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসন জিতলেও ইমরান খান রয়েছেন জেলে। যদিও ইমরান খান জেলে বসেই নিজের দলকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন। পাশাপাশি শাহবাজের প্রধানমন্ত্রী হবার খবরে ভীষণ ক্ষুব্ধ ইমরান ভোটে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কারণ ইমরান খান ও তার দল পিটিআই-এর বিশ্বাস, যে এই নির্বাচনে তাদের বিরুদ্ধে কারচুপি হয়েছে। সে কারণে ভোটের ফলকে তারা চ্যালেঞ্জ জানাবেন। পাশাপাশি শাহবাজকে কোনঠাসা করতে পিএমএল-এনের নেতৃত্বে জোট সরকার ঘোষণার মধ্যে পিটিআই নির্দলদের নিয়ে সরকার গঠনের আশা ছিল ইমরানের। দলের চেয়ারম্যান গহর আলী খান বলেন, কেন্দ্রে কিংবা খাইবার পাখতুনখাওয়া ও পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদে নিজেদের সরকার গঠন করবেন তারা। পিটিআই মুখপাত্র রউফ হাসান জানান, ইমরান খানের নির্দেশনায় পাকিস্তানের কেন্দ্র ও পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদে সরকার গঠনে এমডব্লিউএমের সঙ্গে হাত মেলাবেন তারা। আর খাইবার পাখতুনখাওয়ায় জামায়াত-ই-ইসলামির সঙ্গে জোট গড়বে ইমরানের দল। পাশাপাশি আলোচনায় যাবে অন্য দলগুলোর সঙ্গেও।
গোড়ায় ঠিক ছিল নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) এবং বিলাবল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টির জোট সরকার গঠন করবে। প্রধানমন্ত্রী হবেন প্রথম দলের শাহবাজ শরিফ। তিনি নওয়াজের ভাই এবং আর এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী। জোটের ফরমুলা মতো পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা ছিল বিলাবলের বাবা আসিফ আলি জারদারির। তিনিও সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং পিপিপি’র কো-চেয়ারম্যান। সেই অনুযায়ী সায় দিয়েও পিছু হটছেন নওয়াজ শরিফ। তিনবারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজের ধারণা জারদারিকে রাষ্ট্রপতি করে নিশ্চিন্তে সরকার চালানো যাবেনা। নির্দলদের সমর্থনের স্থায়িত্ব নিয়েও তাঁর সংশয় আছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি ভাইকে প্রধানমন্ত্রী করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বিরোধী বেঞ্চে বসার ভাবনাচিন্তা করছেন। অন্যদিকে, সেনাও মনে করছে, ইমরানের দলের প্রতি যে সমর্থনের ঢেউ উঠেছে তা উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। ফল প্রকাশের পর থেকেই ইমরানের কর্মী-সমর্থকেরা রাজপথে। তাঁদের অভিযোগ, সেনার সাহায্যে ভোট চুরি করে অন্তত একশো আসনে তাদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভোটে কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভ করেছে পিটিআই সমর্থিত নির্দলেরা। জানা যাচ্ছে, এই বাস্তবতা মেনে সেনাও ইমরানের সঙ্গে বোঝাপড়া করার কথা চিন্তা করছে। খবর, ইমরানকে আইএসআই শর্ত দিয়েছে সেনা ছাউনিতে তাঁর সমর্থকদের হামলার জন্য তিনি ক্ষমা চাইলে মামলার ফাঁস থেকে রেহাই পেতে পারেন। যদিও এই প্রস্তাবে ইমরান সায় দেননি। কারণ, রাজনৈতিক মহল মনে করছে, ইমরান জেলে থাকলেও ভোটে সাড়া পাওয়ার অন্যতম কারণ সেনার উপর মানুষের রোষ। এবারের নির্বাচনে তারা ইমরানের দলকে মুছে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু এই প্রথম তারা নির্বাচনে হেরে গিয়েছে। ছ’মাসের বেশি জেলে থাকা ইমরানের দল সমর্থিত নির্দলই সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভ করেছে।