দিনদুপুরে আঁধার নেমে এলে অজস্র হলুদ পাতা উড়ে এসে চোখের পাতায় উবু হয়ে বসে। চোখের তারায় আছড়ে পড়ে উত্তাল সমুদ্রের উদ্দাম আলোড়ন। আদিগন্তে অসংখ্য গাংচিল ডানা ঝাপটায়। টলোমলো চোখের টলটলে সরোবরে নিঃশব্দে আঁকিবুঁকি কাটে প্রাগৈতিহাসিক জল-মাকড়শা। আকাশের অভিমানী গাল বেয়ে গলে পড়ে ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতির বৃষ্টি।

দিনদুপুরে নেমে আসা আঁধারের গালে জমাট বাঁধে মন কেমনের বিন্দু বিন্দু জলোচ্ছ্বাস। ঝাপসা অতীত হাতড়ে আবছায়ার মতো এসে জড়ো হয় আগাছায় ভরা সোনালী আলপথ। বুকের গহীন আঁধারে কুলকুল করে বয়ে যায় তিরতিরে নির্জন নদী। সোনালী দিগর এসে ছুঁয়ে ফেলে মুঠো ভরা প্রতীক্ষার প্রহর। জন্মান্তরের সঞ্চিত ব্যাকুলতা হঠাৎই চলকে পড়ে গুছিয়ে রাখা জীবনের জমকালো বাকলের খাঁজে খাঁজে।

আলোময় জীবন কোন এক ক্ষণে হন্যে হয়ে এক চিলতে আঁধার খোঁজে। জীবনভর এত কথা বলে ফেলার পরেও, বিপুল কথার ভার নিয়ে কুয়াশার আবডালে আজও জেগে থাকে চাতকের অস্থির ঠোঁট। কাউকে অনেক কথা বলার তাড়নায় উৎকণ্ঠিত মধুমাস অনেকটা সময় ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল নদীচরের তপ্ত বালুকণায়। নির্জন চৈত্র বাতাস তা জানে। প্রাচীন বটও জানে। বিবাগী নদীর উদাসী ঢেউও তা জানে। আর জেনেছিল নিবিষ্ট করতল। তবুও জীবন বুঝে উঠতে পারেনি, কতটা কুয়াশা জড়ালে অন্তঃপুরে লুকিয়ে থাকা আঁধারকে ছুঁয়ে ফেলা যায়!         

অনেককাল হোল, আলপথ ধরে অকারণে দিগন্ত পানে হেঁটে চলা হয়নি। অনেককাল হোল, বৃষ্টির গায়ে লেগে থাকা স্মৃতিচিহ্ন খুঁড়ে অতলে পৌঁছানোর ইচ্ছে মনে জাগেনি। অনেককাল হোল, শিমূলের আলো জ্বেলে গহীন জংলী পথে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া আর হয়নি। ‘কাল’ সতত প্রবাহমান। কারও আবেগের কাছে, কারও অনুভবের কাছে, কারও স্মৃতিকাতরতার কাছে, এক মুহূর্ত নিথর থাকার জো নেই। তবু আমরা জীবনভর ঋণী থেকে যাই কালের যাত্রাপথের কাছেই!

সেইবার জঙ্গলের হাত ধরে হারিয়ে যাওয়ার পথে দিনদুপুরে কাজল কালো আকাশ হঠাৎই নেমে এসেছিল কিশলয়ের শাখে শাখে। আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল নব্য যৌবন। হঠাৎ খুশির উল্লাসে উছলে উঠেছিল অগোছালো হৃদয়। মেঘে মেঘে ঘর্ষণের অভিঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল কৃত্রিম সভ্যতায় ঢাকা জীবনের  বাকল। উল্কার মতো উদ্ভ্রান্ত ঝড় এসে একাকার করে দিয়েছিল ছুঁয়ে থাকা মন। দিকবিদিক বিদীর্ণ করে আছড়ে পড়ছিল বল্গাহীন বন্যপ্রেম। ফুলের পাপড়ির আহ্ললাদে জমে থাকা শিশিরের জল চলকে পড়েছিল ঝরা পাতার অভিমানী গালে। ছোঁয়াচ লাগা প্রেম আজও আচমকাই এসে ডানা ঝাপটায় বৃষ্টিস্নাত কদমের ডালে।

রুদ্রপলাশের আকুতির অবসান হলে আবেগাপ্লুত আঁকাবাঁকা নদী এসে আচমকা থমকে দাঁড়ায় ঝরা পাতার রংহীন শবের শিয়রে। রঙিন স্বপ্নের স্বরলিপি গচ্ছিত রাখা বকুলের পাতার আবডালে ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি এসে আঁধার খোঁজে। মাকড়শার জালের মতো কর্তব্যবোধে ঠাসা জীবন থেকে নিযুত আলোকবর্ষ দূরে নির্জনতার ভিড়ে মিশে থাকে অব্যক্ত প্রেম। জীবনের ঘাড়ে অযুত মায়ার পাহাড় এসে জমাট বাঁধে। ব্যস্ততা ও দায়িত্ববোধের ঘেঁষাঘেঁষির ফাঁক গলে ঝরে পড়ে মন কেমনের নিথর শরীর। নীল পাহাড়ও উন্মুক্ত শরীর লুকিয়ে ফেলে সজল মেঘেদের আশ্বাসে। দিনদুপুরে আঁধার নেমে এলে বনপাহাড়ির চোখের কোণে ঝাঁক ঝাঁক মুক্ত বিন্দু আজও টিমটিম করে জ্বলে ওঠে!

লেখক অধ্যাপক, সমজ-রাজনীতি ও পরিবেশ বিশ্লেষক

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version