মুঘল সম্রাট আকবর যেমন বাংলা সনের প্রবর্তন করেন তেমনি তাঁর সময়েই পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের মধ্যে খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। আর পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ জমির মালিকরা অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। সেই উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন হত। সেই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাছাড়া এই দিন হালখাতা তৈরি করা হত;  একটি নতুন হিসাব বই।আধুনিক কালে প্রথম নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। ওই বছর প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে পয়লা বৈশাখ হোম কীর্তন ও পুজো হয়। এরপর ১৯৩৮ সালে ও একই রকম উৎসবের খবর মেলে, কিন্তু ১৯৬৭ সালের আগে ঘটা করে পয়লা বৈশাখ পালন তেমন জনপ্রিয় ছিল না। ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে  শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। তার আগে ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামে একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষ্যে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল। কিন্তু পয়লা বৈশাখ উৎসবের সঙ্গে পান্তা ইলিশ খাওয়ার কি সম্পর্ক তা বোঝা যায়না। জানা যায় ১৯৮৩ সালে রমনার বটমূলে দৈনিক জনকন্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ, (অন্যদিকে সাংবাদিক শহিদুল হক খান নিজেকেই এর উদ্যোক্তা বলে দাবী করেন)পয়লা বৈশাখ পান্তা খাওয়ার রীতি প্রবর্তন করেছিলেন।কিন্তু মাটির পাত্রে পান্তা-ইলিশ খাওয়া কি পয়লা বৈশাখের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি?

বাংলার বহু অঞ্চলে সকালে পান্তা ভাত খাওয়া, মূলত দুপুরে অথবা রাতে রান্না করা ভাত যাতে সকাল বেলা নষ্ট না হয় সেজন্য জল দিয়ে রেখে খাওয়া হত।তখন ইলেকট্রিসিটি বা ফ্রিজও ছিলনা। ফলে গরিব বড়লোক সব পরিবারেই এই চর্চা ছিল। সেই পান্তা হটাৎ পয়লা বৈশাখ উৎসবের অন্যতম অঙ্গ।তার থেকেও বড় বিষয় পান্তার সঙ্গে ইলিশ!এই দুটি পদ যদি পয়লা বৈশাখ উৎসবের অন্যতম অঙ্গ হয় তাহলে কি সেই উৎসবকে সার্বজনীন উৎসব বলা যাবে? কারণ, সর্বস্তরের মানুষের কাছে ইলিশ যে খুব সহজলভ্য তা বলা যাবে না। ইলিশ মাছ মরশুমেই দেড় থেকে দু হাজার টাকার কমে বাজারে মেলে না। জানা নেই বাংলার কোন বাজারে কিংবা নদী থেকে ওঠা ইলিশ হাজার টাকার কমে মেলে। খুব ভেবে চিন্তেই বলা যায়, যে উৎসবের প্রধান অঙ্গ পান্তা ইলিশ তা বাংলার অধিকাংশ মানুষের জন্য পরিহাসের।এই প্রেক্ষাপটে কি করে পয়লা বা পহেলা বৈশাখ উৎসব সার্বজনীন উৎসব হল? তাছাড়া বৈশাখ অর্থাৎ এপ্রিল মাস ইলিশের নদী থেকে সাগরে ফিরে যাওয়ার সময়। এই ইলিশকে জাটকা বলা হয়, এই সময় তো ইলিশ ধরা বারন। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত  ইলিশের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার সময়। সেদিক থেকে হিসাব করলে বছর শুরু উৎসবেই বাঙালি তার সবথেকে প্রিয় ইলিশ হত্যা করে ফেলে। কারণ পয়লা বৈশাখে ইলিশ খাওয়া প্রচলিত হওয়ার কারণে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ইলিশ নদী ও সাগরে ধরা হয়।

১৫৫৭ সালে মোগল সম্রাট আকবর মোট বার মাসের সমন্বয়ে “সন-ই-এলাহী” বা যে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন তা মূলত কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্য বা সুবিধার্থে।এই সময় কৃষক ঘরে নতুন ফসল তোলে। আর্থিক দিক দিয়েও সামান্য হলেও স্বচ্ছল থাকে। ধার-দেনা শোধ করে। মনের আনন্দে নতুন জিনিসপত্র কেনে। বকেয়া খাজনা পরিশোধ করে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা আগের বছরের বকেয়া আদায় করে, হিসাব নিকাষ চুকিয়ে নতুন হিসাবের খাতা খোলে অর্থ্যাৎ হিসাবের খাতাকে করে হাল নাগাদ। এই হালখাতাকে ঘিরেই উৎসবের আমেজে এ দিন সকালে বিন্নি ধানের খই, দই, চিড়ে, মুড়ি ইত্যাদি আর দুপুরে খিচুরি, রুই-কাতলা সহ নানা মাছ,  বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় খাবারের আয়োজন করে। তখন ব্যবসায়ীরা পয়লা বৈশাখের দিন ক্রেতাদের বিভিন্ন মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করত। সোনার দোকানগুলি এখনও ঐতিহ্যগত আনন্দের এই ধারাটি বজায় রেখেছে। এই উৎসবটি তখন থেকেই সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছিল। আর সেই হালখাতার উৎসব এখন পান্তা ইলিশ উৎসব!

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version