সেই সেতারটির কথা মনে আছে। যে সেতার দেখে গৌতম বুদ্ধর জীবনভাবনা বদলে গিয়েছিল। সেতারের তিনটি তার। প্রথম তারটি খুব শক্ত ও খুব টান করে বাঁধা। তৃতীয় তারটি খুব আলগা করে দু’প্রান্তে কোনওরকমে আটকানো আছে, খানিকটা ঝুলে পড়েছে। আর মাঝের তারটি খুব টান করে নয়, খুব আলতো করে বাঁধা। শুধু সেই মাঝের তারটি দিয়েই সুর তুলছেন সুর সাধক। সত‌্যজ্ঞান লাভের তপস‌্যার পর একটি নদীতে স্নান সেরে যখন কুটিরে ফিরছেন বুদ্ধদেব, সুর সৃষ্টির সেই দৃশ‌্য দেখে থমকে দাঁড়ালেন। মনে মনে বুঝলেন, এটাই জীবনের সরল সত্য।

আমাদের জীবন সেতারে সুর তোলার মতো। কঠোর তপস‌্যা করেও নয় আবার চরম বিলাসিতা বা ভোগবাদেও নয়, মাঝের পথই হল আসল পথ। সতত্য লাভের উপায়। ফলে কঠোর কৃচ্ছসাধন নয়, কঙ্কালসার দেহ নিয়ে কোনও কাজ করা সম্ভব নয়, পরিমিত আহার করে সাধনাই হল পথ। শুধু কাজ, কাজ, কাজ বলে নিজেকে ব‌্যস্ত রাখা যেতেই পারে, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না। ‘সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে, কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে, সহজ লোকের মতো?’ জীবনের খাতিরে, জীবীকার খাতিরে, কাজের খাতিরে কাজ করতে হয় আর এই কাজের জন্য থাকতে হয় ব্যস্ত। কিন্তু এই ব্যস্ততাই তো জীবন নয়। সেটা যত তাড়াতাড়ি আমরা বুঝতে পারব, ততই তরতাজা থাকতে পারব।

খুব অবাক লাগে সকালে মেডিক্যাল কলেজে যে চিকিৎসক বিনা পয়সায় রোগী দেখেন, সন্ধ্যায় সেই একই ডাক্তারবাবু নার্সিংহোমে রোগীরই পকেট কাটেন। যে শিক্ষক স্কুলে ছাত্রদের জীবনবোধের পাঠ দেন, সেই শিক্ষক আবার প্রাইভেট টিউশনে পড়ুয়াদের দেওয়া ফি থুতু দিয়ে গুণে নেন। এরকম হাজার উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে। এই যে প্রয়োজনে মানুষ পাল্টে যাচ্ছেন, তা কেন? খুব কি প্রয়োজন? তাতে সাময়িক লাভ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যন্ত্রণাও কি কম? মুখে কোনও হাসি নেই, চোখে কোনও তেজ নেই, চলার মধ্যে কোনও ছন্দ নেই। খালি যন্ত্রের মতো কাজ করে যাচ্ছি আমরা। আর সেই কাজের তাগিদেই প্রয়োজন মতো বদলেও যাচ্ছি। যাকে যতটুকু-যেখানে প্রয়োজন ততটুকুই থাকা, আহা-উহু। প্রশ্ন করলে উত্তর, ‘টিকে থাকতে গেলে যন্ত্র হতে হবে’। সময়ের এই ডাক যদি মেনে নিতেই হয়, তাহলে স্বামীজি যে বলেছিলেন, এই যন্ত্র হওয়াটাই মানুষের বড় বিপদ। মেশিনের হৃদয় থাকে না। যে মানুষের হৃদয় নেই, যে মানুষের অনুভূতি নেই, সে মানুষের বোধও নেই। যে মানুষ কাঁদতে পারে না, সেই মানুষের দরকার নেই।

স্বামীজি বলতেন, কাঁদতে হবে। হাউহাউ করে কাঁদতে হবে। কাঁদলে চোখ শার্প হয়, ভিতরের ব্রহ্ম জেগে ওঠে। এখন প্রশ্নটা হল, আমরা কি নিহিত ব্রহ্মকে জাগাতে চাই? নিহিত ব্রহ্মটা কী? আমার কাছে আমার ব্রহ্ম হল ভালোবাসার জাগরণ। কিন্তু সে কথা শুনছে কে? স্বামী বিবেকানন্দ একবার খানিক আক্ষেপ করেই মহেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, দেশে যখন মানুষের জাগরণের কথা বললাম, তখন সবাই হাসল। তাই ভাবলাম, স্বাধীন দেশে একথা বলি। এমন জাগরণের কথা বলে যাবো এদেশের মানুষ মনে রাখবেন। আশা করেছিলেন স্বয়ং স্বামীজিও। কিন্তু তা হয়নি বোধহয়, উল্টে ভিন দেশের মানুষ বিবেকানন্দর জাগরণ শুনে তাঁদের যা মানসিক ত্রুটি তা ধীরে ধীরে পাল্টে নিয়েছেন, কিন্তু আমরা পাল্টালাম না। কারণ আমরা তো অনুকরণপ্রিয়তায় বিশ্বাস করি। আমরা তো পাল্টাতে চাই না। আমার ভালোবাসাও কি ঠিক তাই? তার হাসি, তার তাকানো, তার হাঁটা-চলা, টুকরো টুকরো সুখ-দুঃখ, তার বিষণ্ণতা আমাকে দূর থেকে স্পর্শ করে। ওসব নিয়ে ঘাঁটতে আমি চাইনি কোনওদিন। মনে হয়, ওসব নিয়েই তো মানুষটা!

ভালোবাসা থাকুক না ঠিক তেমনই, যেমন থাকতে তার ভালোলাগে! কারণ, দুঃখ ও সুখ, দুই-ই উদ্‌যাপন করার নামই জীবন। ভালোবাসাকে এখন মিস করি, নিজের কান্নাকে মিস করি। মনে হয়, কেঁদে ফেলতে পারার চাইতে বড় ঐশ্বর্য আর নেই। বেঁচে থাকার কেবল দুটি রাস্তা সামনে খোলা আছে, হয় চিৎকার করে কাঁদো, নয়তো সেই ভালোবাসার কাছে ছুটে গিয়ে বলা, তুমিও কাঁদো। কাঁদতে শেখো শ্রাবণের কাছে। তুমিও জাগো, জাগতে শেখো আগ্নেয়গিরির কাছে। তুমিও ডাকো, ডাকতে শেখো ভোরের পাখির কাছে। তুমিও হাঁটো, হাঁটতে শেখো কচ্ছপের কাছে, ধীর পায়ে জীবন রেসে প্রথম হও। তুমিও বাঁচতে শেখো, বাঁচার মাতো হাঁটতে শেখো, হাঁটার মতো চলতে শেখো, চলার মতো বলতে শেখো, বলার মতো জীবনের কঠিন বাঁকেও ভালোবাসতে শেখো।

লেখক দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিক  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version