ইস্কুলে ইংরেজি, ভূগোল আর হিন্দিতে ভালো ফলাফল করলেও তাঁর পছন্দের বিষয় ছিল বিজ্ঞান। একবার গণিতের ক্লাসে শিক্ষক যখন তাঁকে বললেন নাল সেটের উদাহরণ দিতে, তিনি তখন বললেন- ভারতীয় নারীরা নাল সেটের প্রকৃষ্ট উদাহরণ, কারণ তখন পর্যন্ত কোনওভারতীয় নারীই মহাকাশ বিজ্ঞানী হতেপারেননি।

গরমকালে যখন মা-বাবা-দাদা-দিদিদের সঙ্গে রাতে ঘরের ছাদে শুয়ে থাকতেন, তখন তিনি রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা তারাদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতেন। বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কারনেল ফ্লায়িং ক্লাব থেকে উড়ে যাওয়া বিমানের দিকে তাকিয়ে তিনি হাত নাড়তেন। পরবর্তীতে তিনি এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে করতে বলেন, “আমরা বাবাকে বলতাম আমাদের বিমানে চড়াতে তখন বাবা আমাদের পুষ্পক আর খেলনা বিমানে চড়াতে নিয়ে যেতেন। আমার মনে হয়, সেটিই আমাকে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল”।

ইস্কুলে যখন তাঁর সহপাঠীরা পাহাড়-পর্বত, আকাশ, মাটি, মানুষ আঁকত- তখন তিনি বিমানের ছবি আঁকতেন। চারুকলার ক্লাসে তিনি বিভিন্ন ধরনের বিমানের মডেল তৈরি করতেন। কল্পনা ছেলেদের মতো চুল কাটতেন। অন্য মেয়েরা নাচ, গান পছন্দ করলেও তিনি সাইক্লিং, ব্যাডমিন্টন, দৌড় ভালোবাসতেন।

এই মেয়ে ১৯৯৭ সালে প্রথম বার কল্পনা স্পেস সেটাল কলম্বিয়া ওরানোর সুয়োগ পান। ২০০০সালে তাঁকে ২য় স্পেস মিশনের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল,সঙ্গে আরও ছ’জন ক্রু মেম্বার ছিল। কিন্তু কিছু টেকনিক্যাল সমস্যার কারনে মিশনটি বন্ধ হয়ে যায়। এসটিএস-১০৭ মিশনে তাঁকে মিশন স্পেশালিস্ট হিসেবে নির্বাচন করা হয়। সেটি ছিল স্পেস শাটল কলম্বিয়ার চূড়ান্ত অভিযান। ২০০৩ সালে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে মহাকাশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন তিনি ছাড়াও মোট সাতজন। স্পেস শাটলটি প্রায় ১৬ দিন মহাকাশে অবস্থান করে। তবে পরে জানা যায়, শাটলটি উড্ডয়নের পরই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও মিশনটি সফলভাবে চলতে থাকে। ২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মহাকাশযানটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশ করে। কিন্তু কেনেডি স্পেস সেন্টারে অবতরণের ১৬ মিনিট দূরত্বে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়।

বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে বিস্ফোরিত হয়ে যায় মহাকাশযানটি। এতে মিশনের সাত অভিযাত্রীই প্রাণ হারান। সেই সাতজনের একজন কল্পনা চাওলা। চেনা বায়ুমণ্ডলই যাঁকে ঘরে ফিরতে দেয়নি।

যা জানা যায় তা হল, স্পেস লন্চ হওয়ার সময় পৃথিবীতে থাকতেই বড় সমস্যা হয়, লন্চ হওয়ার পর স্পেস সেটেলের ভারি টেঙ্ক থেকে ফোর্ড ইন্চুলেন্টের একটি টুকরো ভেঙে যায়এবং ওর বাকিটা বাম টুইনে ধাক্কা খায়। যে স্পেন সেটেলে কল্পনা চাওলা ও তার সঙ্গীরা যাচ্ছিল তা ড্যামেজ হয়ে যায়। কিন্তু কল্পনা চাওলা ও তার তাঁর সঙ্গীরা পৌছে যায় স্পেসে। দুঃখজনক বিষয় হলো নাসা(NASA)এই খবরটি কল্পনা চাওলা ও তার সঙ্গীদের জানতে দেয়নি। তাদের পৃথিবীতে ফিরে আসার একমাত্র পথ বন্ধ হয়ে গেছে। পরে নাসা(NASA) বলেছে যে “যদি তাদের এই খারাপ খবরটা জানিয়ে দেওয়া হত তাহলেতাঁরা কাজ করতে পারতন না।অর্থাৎ নাসা(NASA) নিজের কাজ উদ্ধারের কারনে সেই ৬জন আর কল্পনা চাওলার সবথেকে খারাপ খবরটি জানায়নি। ১৬দিন পর কাজ শেষ করে কল্পনা চাওলা ও তার সঙ্গীরা পৃথিবীতে আসার অভিযান শুরু করলো।কিন্তু পৃথিবীতে ফেরার সময় এর গরম বেসিস ওই গরম জায়গা দিয়ে স্পেস সেটেলের ভেতরে পুরো ভর্তি হয়ে যায়।আর এর জন্য স্পেস কপ্ট ইন্টারনাল স্ট্রাকচার নষ্ট হয়ে যায়। আর পুরো স্পেসটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়।এই ঘটনা ঘটে ২০০৩ সালের১ ফেব্রুয়ারি।

কল্পনা চাওলার মহাকাশে হারিয়ে যাওয়ার ২০ বছর আজ। মৃত্যুর দু’দশক পেরোলেও স্মৃতিতে গেঁথে আছেন এই মহাকাশচারী কন্যা। তাঁর স্মৃতিতে মঙ্গল গ্রহের একটি পর্বতচূড়ার নাম দেওয়া হয় ‘কল্পনা হিল’। এ ছাড়া ‘এসএস কল্পনা’ নামে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে যাওয়া একটি মহাকাশযানের নামকরণ করে নাসা। আর কল্পনার জন্মভূমি ভারত তাদের প্রথম মেটেরোলজিক্যাল স্যাটেলাইটের নাম রাখে ‘কল্পনা-১’।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version