পর্ব-পঞ্চম

বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, নতুন বছর নতুন বছর বলে খুব হইচই করার কিস্যু নেই৷ যখনই কোনও নতুন বছর এসেছে, এক বছরের বেশি টেকেনি৷ হোয়াটস অ্যাপে এই মেসেজটা কেমন যেন এক চরম বাস্তবের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের৷ অনেককেই বলতে শুনেছি, এটা বছরের সেরা ছিল৷ তবে, মানি ছাই না মানি খবরের কাগজগুলিতে চোখ রাখলে বা টিভি চ্যানেলগুলি দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না আমরা যেমন বর্ষবিদায়ের আনন্দে মেতে উঠছি, তেমনই ‘এসো হে বৈশাখ’, থুড়ি জানুয়ারি বলে আনন্দে একবারে চোদ্দোখানা৷ ভাবখানা এমন, যে পয়লা জানুয়ারি আসার অপেক্ষায় একেবারে চাতক পাখির মতো বসেছিলাম৷ এই একটা তারিখেই যেন ‘উল্টাবে আজ পৃথিবীর কাজ দারুণ অসম্ভবে৷’ হলুদ সিংহ দৌড়ে এসে ‌যেন লাফ দেবে নীল জলে, আর তুমি গুটিগুটি পায়ে সুবোধ বালিকা হয়ে চলবে আমার সঙ্গে সুন্দরের জঙ্গলে৷

পয়লা জানুয়ারি এসে গেলেই যেন শ্যামলকান্তি রোদ্দুর হয়ে যাবে, শিকড়ে ধরা শ্যাওলা শুকনো হয়ে চৈত্রদিনের ঝরাপাতার মতো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে৷ আমাদের রোগা শুঁটকো কাঠামোর উপর পড়বে মাটির প্রলেপ, শকুনের দৃষ্টি চাইবে ঊধর্বগগনে বাজপাখিও আর ঠুকরে খাবে না শূন্য ভাতের থালা৷ মুহূর্তে মুছে যাবে দেশভাগের চিহ্ন, যুবিমান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে রাশি রাশি টফি৷ আসলে সারা বছরের ‘ঝেলতে’ থাকা জীবনের দুধের প্যাকেট, চিকেন চাপ, পাউরুটি-বিস্কুট. পুরনো ঘাট, পকেট ছেঁড়া পাঞ্জাবি, ফুলে ওঠা ভুঁড়ি, ফ্যাসফেসে সঙ্গমের স্বাদ বদলানোর জন্য বিদ্রোহী মন এই শীতে জেগে উঠতে চায়৷ জর্জরিত, রণক্লান্ত, হা-পিত্যেশ মন খুঁজে পেতে চায় রোদের সরল ছায়া-পড়া বারান্দা, নিঝুম কার্নিশ, প্ররোচনাহীন সুবাতাস৷ কারণ বছরভর তো সেই ‘সা নি ধা পা মা’ জীবনযাপনে ভুল করে চায়ের দোকানে কফির খোঁজ করা, ফুসফুসে টান পড়লেই সিগারেট ধরিয়ে দেওয়া, হিংসা থেকে বাঁচতে দ্বিচারিতার কোল খোঁজা, মাছ আঁকতে গিয়ে কুমির এঁকে ফেলা, ইতিহাস গোপন করতে গিয়ে বেলেল্লাপনা করার মতো সিন্দুকে নিজেদের বন্ধক রাখা৷ বা রাখতে বাধ্য হওয়া৷ চাপের নাম বাপ৷

তাই বর্ষবিদায়ের তিথি ঘোষিত হলেই ‘ঢের হয়েছে, আর নয়’ বলে ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট করে ফেলি৷ ফলাও করে নিউ ইয়ার রেজোলিউশন ঘোষণা করি৷ বর্ষশেষের রাতে নেশা-ভাং করে কামনার বাতি জ্বেলে স্বর্গ-নরকের প্রভেদ ভুলতে জাগিয়া ওঠে প্রাণ৷ হঠাৎ যেন আবিষ্কার করে ফেলি আমার আমিকে৷ আর বিহর ভিক্ষা নয়, আর একতারা হাতে বৈরাগ্য নয়, আর ডাল-ভাত-রাঙা আলুর চচ্চড়ি নয়, আর নয় কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ ভালবেসে বাস্ত্তসাপ পোষা৷ পয়লা জানুয়ারি থেকেই হাতে তুলে নেব ধনুর্বাণ৷ পৃথিবীর নষ্ট রণভূমি থেকে একে একে সরাব সব বিষধর খরিশকে৷ এই ধরাধামে বুনব সূর্যমুখীর বীজ৷ চৌকাঠে আঁকা হবে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন৷ নিউ ইয়ার রেজোলিউশন৷ যে যেরকম পারে নতুন বছরের শপথ তো না হয় নিল৷

পয়লা সেলিব্রেশনের হ্যাং ওভার কাটিয়ে পরের দিনগুলিতে ঘুম থেকে উঠে সবগুলো শপথ দুর্গার অষ্টতরো শতনামের মতো না হয় আউড়ে নেওয়া গেল৷ কিন্ত্ত শপথ পালনের কী হবে? সে তো মুখের কথা বা মামাবাড়ির দুধভাতও নয়৷ তার চেয়েও বড় কথা, আপনাকে শপথ পালন করতে দিচ্ছে কে? সমাজ, দেশ, রাষ্ট্রের এত ফালতু সময় নেই৷ আপনি সমাজব জীব হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন, সুতরাং সমাজ-দেশ শিরোধার্য৷ তাদের মাথায় যাঁরা বসে আছেন (আমরাই বসিয়েছি) তাঁদের শপথ, ইচ্ছা আপনি মানতে চান বা নাই চান, অগ্রাহ্য করতে পারবেন না৷ তাঁরা বদলালে আপনাকেও বদলাতে হবে, বা বদলের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে৷ তাঁরাই ঠিক করবেন নতুন বছরে দুধস্রোতে পা দিয়ে নাকি, মাথার চলকে ওঠা রক্ত তাড়িত হয়ে দেশ চলবে৷ আপনি তখন গাছের একটা ডাল মাত্র৷ আপনি কাটা পড়লেও গাছ মরবে না, বরং সেখান থেকেই গজাবে নতুন কোনও

ডাল৷ কিন্ত্ত গাছ মরে গেলে ডালের কোনও অস্তিত্ব নেই৷ এই সরল তত্ত্ব আপনার নিউ ইয়ার রেজোলিউশনগুলিকে গুলিয়ে দেবে৷ অতএব ‘কর্তার ইচছায় কর্ম’ বা ‘তোমার ছাগল, তুমি কোন দিক থেকে কাটবে সেটা তোমার ব্যাপার’ গোছের চলতি প্রবাদ আউরিয়ে জীবনটাকে গড়িয়ে দিতে দাও৷ দেখতে দেখতে মৃত্যুর দিকে আরও একটা বছর এগিয়ে যাওয়া৷ আসছে বছর আবার হবে বলে এবারের নেওয়া শপথগুলির গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটিয়ে দেওয়া৷ আরে বাবা বছরের শুরুই হোক বা শেষ আমাদের তো একটাই প্রার্থনা, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে৷’

(শেষ)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version