শুধু কি প্রথাবিরোধী গান করেই পিট সিগার কিংবদন্তী হয়েছিলেন? লোকসঙ্গীতের প্রতি তার ভালবাসাই তাকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। কেবল গান লিখে আর তাতে সুর দিয়ে শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করেননি, আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া লোকগান উদ্ধারে তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। গত শতাব্দীর চারের দশক থেকে পাঁচের দশকে আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলন, সামাজিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের কথা বারবার উঠে এসেছে পিট সিগারের গানে। পরবর্তীতে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী গান,  সাতের দশকে যুদ্ধবিরোধী ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে তার গান অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। পিট সিগার ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটিকে গির্জার ডায়াসের বাইরে সাধারণ মানুষের প্রাণের সঙ্গীত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ষাটের দশকের গোড়াতেই তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। তাঁকে চিহ্নিত করা হয় আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিস বলে। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন পিট সিগারের রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় দর্শন এবং চিন্তা-ভাবনাকে কিছুতেই দমাতে পারেনি। তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেছিলেন, একজন মার্কিন নাগরিক হিসেবে তার বিশ্বাস ও রাজনৈতিক চেতনার উপর কারও হস্তক্ষেপ কোনও ভাবেই কাম্য নয়। পিট সিগার ষাটের দশেকের আমেরিকা জুড়ে চলা ‘সিভিল রাইটস আন্দোলনে’র অন্যতম পুরোধা ছিলেন।বিশ শতকের প্রতিবাদী চরিত্র পিট সিগারের গানই ছিল তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন শোষকের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। সারা জীবন শাসিতের পক্ষে দাঁড়ানো এই মানবতাবাদী মানুষটি মেঠো লোকসুরকে সঙ্গী করে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, আর তাঁর গানের ভাষায় আপামর মানুষ পেয়েছিল সংগ্রামের প্রেরণা।

মুক্তিপাগল মানুষের প্রতিনিধি পিট সিগার বরাবরই ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। ১৯৬৩ সালে তিনি মিসিসিপিতে ছাত্রদের এক অহিংস আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে যোগ দেন। ভিয়েতনামের যুদ্ধে বিপর্যস্ত আমেরিকার জনগণকে তিনি প্রতিবাদের ভাষা চিনতে শিখিয়েছিলেন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে তিনি প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মঞ্চকেই বেছে নিয়েছিলেন। ম্যানহাটনের স্কুলের বারান্দা থেকে  নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তার ধার- সর্বত্রই তার প্রতিবাদী গানের সুর ঝড় তুলতে শুরু করে। গোলা-বারুদ জঙ্গী বিমানের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যাঞ্জোর মূর্ছনা হয়ে ওঠে শান্তি আর ভালোবাসার গান। পিট সিগারের এই ভূমিকায় ভীতসন্ত্রস্থ মার্কিন প্রশাসন তাঁকে কারারুদ্ধ করে। কিন্তু তাতেও থামানো যায়নি তাঁকে। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই পিট সিগার গেয়ে ওঠেন ‘হোয়ার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন’।

গতশতাব্দীরচারেরদশকেরএকেবারেগড়ায়তিনিগান লিখতে শুরু করেন।এরকিছুদিনপরেইতিনি মিলার্ড ল্যাম্পেল এবং লি হেইসেরসঙ্গে’অ্যালম্যান্যাক সিঙ্গারস’ নামে একটি লোকসঙ্গীতের দল তৈরি করেন। বলা যায় একেবারে শুরুতেই ওঁদের তৈরি গান The Talking Union Blues শ্রমিকদের মধ্যে তুমুল আলোড়ন সৃস্টি করে। এরপর ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে ওঁদের গান The Balled of October 16 আমেরিকান সঙ্গীত সমাজে এক নতুন ভাষা তৈরি করে। ‘অ্যালম্যান্যাক সিঙ্গারস’-এর কিছু গান ১৯৪২ সালে রেকর্ড হবে বলে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরওসেই রেকর্ড আর হয়নি। অগত্যা পিট সিগার একটি সঙ্গীত বিষয়ক পত্রিকা ‘সিঙ্গ আউট’ সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। সেখানে লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একক সঙ্গীতের অনুষ্ঠান করতে শুরু করেন।

চারের দশকের শেষাশেষি পিট সিগার নিউ ইয়র্কের গ্রামের এক স্কুলে যোগ দেন সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে। বছর খানেকের মধ্যে অ্যালম্যান্যাক-কে ফের নতুন করে গড়া হয় তবে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘দ্য ওয়েভার্স’। সেই দলে যুক্ত হন লি হেইস, রনি গিলবার্ট, ফ্রেড হেলম্যান প্রমুখ। ইতিমধ্যে পিট সিগার সমাজতন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছেন, নানা প্রতিবাদে-প্রতিরোধে নিজেকে এবং ‘দ্য ওয়েভার্স’-কে যুক্ত করার কারণে মার্কিন সরকারের চোখে নিজে এবং তাঁর দলকে শত্রু প্রতিপন্ন করে ফেলেছেন। মার্কিন সরকার ‘দ্য ওয়েভার্স’-কে বামপন্থীদের একটি শাখা হিসেবে চিহ্নিত করায় ওয়েভার্স-এর গান করার অনুমতি বাতিল হয়ে যায়। এক সময় দলটির কার্যক্রম প্রায় বছর দুয়ের জন্য থমকে যায়। কিন্তু আবার তারা একসাথে মঞ্চে গান পরিবেশন করতে শুরু করেন। ‘সিং আউট’ ম্যাগাজিনে ১৯৫৫ সালে পিট সিগার লেখেন Where Have All the Flowers Gone? পরে জো হিকারসন এই কবিতাটিকে গানে রূপান্তরিত করেন। বলা যায় এই গানটিই প্রথম যুদ্ধবিরোধী গান হিসেবে মানুষকে সচেতন করেছিল।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে ইরাকের যুদ্ধ, পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলন, ওয়াল স্ট্রিট দখল অভিযান থেকে হাডসন নদী বাঁচাও আন্দোলন- দুনিয়ার সমস্ত প্রতিবাদী মানুষ লড়াইয়ের ময়দানে তাঁর নিজের ভাষায় গেয়েছে ‘আমরা করবো জয় একদিন’।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version