এর্নেস্তো রাফায়েল গুয়েভারা দে লা সের্না। বেশ বড়সড়ো একটি নাম। কিন্তু কেউই তাঁকে কোনোদিন এই নামে ডাকেনি। গোটা বিশ্বের কাছেই তিনি চে’। অথচ তাঁর পুরো নামের মধ্যে কোথাও ‘চে’ শব্দেটির কোনো অস্তিত্ব নেই। আসলে স্প্যানিশ শব্দ চে’র অর্থ প্রিয়। ল্যাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে কিউবায় তাঁকে ডাকা হতো চে বলে। অর্থাৎ তিনি প্রিয়জন। সেই থেকে মানুষের মুখে মুখে তিনি হয়ে যান চে, আর সেই সঙ্গেই হারিয়ে যায় তাঁর প্রকৃত নাম। একসময় তিনি স্বাক্ষরও করতেন ‘চে’। এভাবেই ‘চে’ হয়ে ওঠেন বিশ্বখ্যাত বিপ্লবীর সিগনেচার নেম।
কল্পলোকের রূপকথায় রাজ্য থাকে, রাণী থাকে, রাজকুমার, রাজকুমারী সবই থাকে, আর থাকে ছিল ক্ষমতা। চে যে রূপকথার নায়ক, সে রূপকথা কল্পলোকের নয়, বাস্তবের। যদিও তাঁর রূপকথায় রাজ্যে রাণী ছিল, রাজকুমার, রাজকুমারীও ছিল আর ছিল ক্ষমতা। কিন্তু সবকিছুই ছেড়েছিলেন তিনি।পুরোদস্তুর মেধাবী ডাক্তার হয়েও লোভনীয় জীবনের যাবতীয় হাতছানিকে উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছিলেন জল-জঙ্গলের গেরিলা জীবন। সবকিছু ছেড়েছুড়ে বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। ছেড়ে এসেছিলেন আলেইদাকে। জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনায়, কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য তিনি ক্ষমতা ছেড়েছিলেন তুড়ি মেরে। বিশ্ব মানবতার মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন গুয়েতেমালা থেকে। তারপর কিউবা, কঙ্গো হয়ে বলিভিয়ায়। স্বপ্ন ছিল ল্যাটিন আমেরিকার মানুষের মুক্তি ঘটিয়ে বিপ্লবের লক্ষ্যে পাড়ি দেবেন আফ্রিকা, তারপর এশিয়া, ইউরোপ হয়ে গোটা বিশ্ব। তারপর প্রিয় পুত্রকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন চাঁদে। তাঁর সেই স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। পূরণ হতে দেয়না সিআইএ-বলিভিয়ার সামরিক সেনারা। গুলি করে হত্যা করা হয় চে-কে।
এরপর তাঁর আদর্শ, তাঁর প্রত্যয় ও প্রতীতি পৃথিবীর সর্বত্র তারুণ্যের টি শার্টের বুক জুড়ে রয়ে গিয়েছে, তাঁর ছবি ব্র্যান্ড হয়ে গিয়েছে। কেবল তরুণদের কাছে নয়, প্রায় সব বয়সীরাই চে’র লোগো সম্বলিত ক্যাপ ব্যবহার করেন। কফির মগ ও চায়ের কাপেও রয়েছে চে’র উপস্থিতি। যে চে’র ক্যাপ আমরা ধারণ করে থাকি, যে চে’র ছবি সম্বলিত টি-শার্ট আমরা গায়ে জড়িয়ে থাকি, সেখানে চে’র ছবিটা থাকে মাথায় অথবা বুকে। কিন্তু চে-কে আমরা কতোটা মাথায় রেখেছি? চে’ কী সত্যিই আমাদের বুক জুড়ে রয়েছেন, নাকি কর্পোরেট দুনিয়ার আর দশটা পণ্যের মতো করেই আমরা চে’কেও কেবলই পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছি?
চে কবিতা শুনতে পছন্দ ভাল বাসতেন, কেবল শোনা নয়, নিজেও কবিতা লিখতেনও। বিপ্লবী চে তাত্ত্বিক ছিলেন। কিন্তু তত্ত্বকথাতেই নিজের দায় ও দায়িত্বের ইতি টানেননি। তত্ত্বের সার্থকতা যে কেবল প্রয়োগেই চে জীবন দিয়ে সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বামপন্থায় সমর্পিত প্রাণ চে কিন্তু সেই বামপন্থাকেও বুঝেছিলেন নিজের ভূগোলের বাস্তবতায়। এই প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি কখনোই। তিনি মনে করতেন বিশ্ব মানবতার মুক্তি না ঘটলে কোনো এক বিশেষ দেশ তো দূরের কথা একটি বিশেষ অঞ্চলেরও যথাযথ মুক্তি হতে পারে না।’হাস্তা লা ভিক্তোরিয়া সিয়েম্প্রে’ অর্থাৎ জয়ী না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু হায় চের মৃত্যুর পর যেন জীবনানন্দ দাশের পঙক্তি সত্যি হয়ে যায়- ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর!’