একদা চৈতন্যদেব হরিনাম গেয়ে জগৎসংসার মাতিয়েছিলেন। এরপর হরিনামের ভক্তিরসে জোয়ার এনেছিলেন নিতাই। বাংলা তথা বাঙালির ভক্তির ভূবনে এ যেমন একটি দিকের ধারা তেমনি অন্যদিকে রয়েছে আরেকটি ধারা সেটি হল কালীসঙ্গীত বা শ্যামাসঙ্গীত। আজও যেমন বৈষ্ণব ধর্মীয়সমাজ ছাড়াও অন্যান্যরা হরিসংকীর্তনে মাতোয়ারা হয় পাশাপাশি বাঙালির শ্যামাপুজোর কথা ভাবা যায়না রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখের শ্যামাসঙ্গীত ছাড়া। কালীপুজোর মণ্ডপ থেকে পান্নালাল কিংবা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্জের কণ্ঠে গাওয়া “মায়ের পায়ের জবা হয়ে” অথবা “আমার সাধ না মিটিল” ভেসে আসবে না তা ভাবা যায় না। সময় পালটেছে তার সঙ্গে বাংলা গানের ধারায় ঘটেছে নানা রদবদল কিন্তু যুগ যুগান্ত ধরে ভক্তিরসের স্রোতে শ্যামাসঙ্গীতের যে আকুল আবেদন তা মনে হয় বাঙালি হৃদয়কে আজও ব্যাকুল করে। বাংলা গানে নানা পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু শ্যামাসঙ্গীতে তেমন কোনো রদবদল ঘটাননি ভক্তিগীতির গায়কেরা। এখনও পর্যন্ত শ্যামা সঙ্গীত তার নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়েই বাঙালি জীবনে রয়ে গিয়েছে।
সুদূর অতীত থেকে শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন বহু গুণীজন, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, দেওয়ান ব্রজকিশোর রায়, দেওয়ান রঘুনাথ রায়, রামনিধি গুপ্ত, দাশরথি রায়, রাজা শিবচন্দ্র রায়, অযোধ্যানাথ পাকড়াশী, অতুলকৃষ্ণ মিত্র, ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল, রামলাল দত্ত, গোবিন্দ অধিকারী।রবীন্দ্রনাথ ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-য় লিখেছিলেন ‘কালী কালী বল রে আজ’। দুর্গাদাস লাহিড়ীর ‘বাঙালীর গান’-এ তানসেনের ইমনকল্যাণ রাগে ও তেওড়া তালে নিবদ্ধ দুষ্ট দুর্জ্জন দূর করো দেবি/ করো কৃপা শিও শঙ্করী মা/ হর আলা পর দার বিরাজে/ মন মানে ফল পাঁওয়েরি..’ গানটির উল্লেখ করেছেন। নানাজনের সুরে অথবা প্রচলিত সুরে শ্যামাসঙ্গীত পরিবেশনে অসামান্যতা দেখিয়েছেন কে মল্লিক, ভবানী দাস, মৃণালকান্তি ঘোষ হয়ে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হীরালাল সরখেল, রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী।তবে একটা কথা বলতেই হয়, বাঙালির মনে ও কানে শ্যামাসঙ্গীতের সঙ্গে যে শিল্পীর কণ্ঠ সবচেয়ে বেশি মিশে গিয়েছে, তিনি পান্নালাল ভট্টাচার্য। বাঙালির জীবনের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে রামপ্রসাদের “আসার আশা, ভবে আসা”, কমলাকান্তের “শ্যামা মা কি আমার কালো”, দাশরথি রায়ের “দোষ কারও নয় গো মা”, রজনীকান্ত সেনের “আমি সকল কাজের পাই হে সময়” ইত্যাদি গান। এই সব গানের সঙ্গে মিশে আছে বঙ্গ সংস্কৃতি, লোকাচার, ইতিহাস ও দর্শন। রামপ্রসাদ সেনের কথায়, সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে, পান্নালাল ভট্টাচার্যের- “চাই না গো মা রাজা হতে/ রাজা হবার সাধ নাই মাগো/ দু’বেলা যেন পাই মা খেতে”।
জানা যায়, উনিশ শতকে কালীকে ঘিরে যে দার্শনিক বিতর্ক হয়েছিল, তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ এবং নিবেদিতা। রবীন্দ্রনাথ কালী রক্ত চায়, হিংসা চায়, তাই কালীমূর্তিকে সমর্থন করতে পারেন নি। অন্যদিকে, বিবেকানন্দ ও নিবেদিতার কাছে মা কালী ছিলেন মৃত্যুরূপা মাতা। সেই সময় কালী-ভাবনা সশস্ত্র বিপ্লবীদের আন্দোলনকেও আলোড়িত করেছিল। শাসক ব্রিটিশদের হত্যা করতে কালী মায়ের নাম নিয়ে বোমা বাঁধতেন দুঃসাহসী বিপ্লবীরা। কালী পুজোর গানগুলির মধ্যে অন্যতম কালী কীর্তন। প্রায় ১৩৯ বছর পুরোনো হাওড়া জেলার আন্দুল কালী কীর্তন সমিতির হাত ধরে আজও বেঁচে এই অমূল্য শিল্প। একসময় শ্যামা সঙ্গীতের এই মধুর সুরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। তার অনন্য সৃষ্টিগুলির মধ্যে অন্যতম “কালো মেয়ের পায়ের তলায়” বা “বল রে জবা বল” আজও কালীভক্তদের পৌছে দেয় এক অন্য জগতে।
বাঙালি মনে কালীচেতনা ছড়িয়ে পড়ার মূলে রয়েছেন রামপ্রসাদ সেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি হিসাবেই কালীর ভাব ছড়িয়ে দেন তিনি তাঁর অপূর্ব সংগীতের মাধ্যমে। এক অন্য ঘরানার সাধক ছিলেন রামপ্রসাদ। তাঁর গানের কথায় যেমন ভাব, উপমা, ভাষা তেমনি সুরের চলনে অতি সরল, হৃদয়স্পর্শী যা বাঙালির মন স্পর্শ করেছিল এক লহমাতেই। রামপ্রসাদের কথা, ‘জেনেছি জেনেছি তারা তুমি জান ভোজের বাজি/ যে তোমায় যে ভাবে ডাকে তাতেই তুমি হও মা রাজি’। যেন কালীসাধনার নানা ধারার সমন্বয়ের কথাটিই এখানে বলা। আবার এর মধ্যে যেন গীতার বাণীও লুকিয়ে আছে। রামপ্রসাদের গানের ধারা নতুন অভিমুখ পেয়ে প্রবাহিত হয় কমলাকান্তের অনুভবে। কমলাকান্ত বলেন, ‘জান না রে মন পরম কারণ/ কালী কেবল মেয়ে নয়/ সে যে মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ কখনও কখনও পুরুষ হয়।/ হয়ে এলোকেশী করে লয়ে অসি/ দনুজ তনয়ে করে সভয়।/ কভি ব্রজপুরে আসি বাজাইয়ে বাঁশি ব্রজাঙ্গনার মন হারিয়ে লয়’।এই কথার মধ্যে সেই মহামিলনের অনুষঙ্গ এবং সমর্পণের ভাষা, একই সঙ্গে সুরের ধারাতেও নতুন বৈচিত্র। ভাবের সঙ্গে রাগের সমাহারে শাক্তসংগীতের একেবারে নতুন স্রোত।