বছরভর জমে থাকা অব্যক্ত কথার ভিড় হিমেল রাতের কুয়াশার আবডালে বিলীন হয়ে যায়। ভোরের সমুজ্জ্বল শিশিরের চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে নতুন দিনের ঝলমলে রোদ্দুর। বুকের বাঁদিকের রক্তস্রোতে উত্তাল জোয়ার আনে বানভাসি সমুদ্দুর।
পরিবারের পূর্ব প্রজন্মের প্রায় সকলেই বিলীন হয়েছেন কালের যাত্রায়। শিথিল হয়েছে কয়েক প্রজন্ম ধরে আগলে রাখা অকপট মূল্যবোধ। সেই শিথিলতার ফাঁক দিয়ে বন্যার স্রোতে আছড়ে পড়েছে “আমাকে আমার মতো থাকতে দেওয়ার” দীক্ষামন্ত্র। ব্যাক্তি জীবনের আমূল পরিবর্তনের অনিবার্য প্রভাব পড়েছে সমাজ জীবনে। বদলেছে সমাজের চরিত্র।
সামাজিক বন্ধনের যোগসূত্রগুলোর তার ধারাবাহিকভাবে ছিঁড়েই চলেছে। এতবড় বসত দ্বীপে আমরা এতজন! অথচ একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলেছি প্রতিনিয়ত! যেমন, এতবড় আকাশে এতগুলো তারা। তবু সকলেই একে অন্যের থেকে আলাদা! প্রবলভাবে একা। সেই কবে জীবনানন্দ লিখেছিলেন না … “সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়”!
এই বিচ্যুতির অনিবার্য প্রভাব এসে পড়েছে রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপেও। সকলের জন্য নির্মিত গণতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের পরিখার আবর্ত থেকে। হয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই। অথচ গণতন্ত্র তো ‘জন স্টুয়ার্ট মিল’ বর্ণিত “গভর্নমেন্ট বাই ডিসকাশন” বা “আলোচনার মাধ্যমে সরকার পরিচালনা”-ও বটে! যেমনটি হতো প্রাচীন এথেন্সের ‘আগোরা’র নাগরিক মত-বিনিময়ের উন্মুক্ত চত্বরে।
ছোটবেলায় চাক্ষুষ করা জনতার সালিশি সভার কথা লিখে রেখে গেছেন ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’ তাঁর আত্মজীবনী ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’-এ। সত্তরের দশকের ঝাঁঝালো বঙ্গীয় অতি বাম নেতারাও তাঁদের স্মৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, তত্ত্বে বর্ণিত ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার গোলকধাঁধা থেকে সরে এসে মুক্তমনা বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিসরকে স্বীকার করে নিয়েছেন। অথচ, দেশ জুড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদ ক্রমশই সংকুচিত করে ফেলছে (ভাবনার) সংখ্যালঘুদের মতামত, ভাবাবেগ, গুরুত্ব এবং অস্তিত্ব।
এমনই এক ঘোর সন্ধিক্ষণে ডিম্বাকার পৃথিবীটা আরও একবার সূর্যের চৌদিক প্রদক্ষিণ করে ফেললো। প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম মেনেই নির্দিষ্ট একটি সময়ের অন্তে পুরানোকে বিদায় জানাতে এবং নতুনকে সাদরে গ্রহণ করে নিতে হয়। কিন্তু জীবনের পথ চলতে চলতে যা কিছু জড়িয়ে যায়, ছেড়ে গেলেও তাঁকে বিদায় জানানোর মতো ঔদার্য কি আদৌ দেখাতে পেরেছি! ছেলেবেলার ইস্কুল, থইথই খেলার মাঠ, জলফড়িঙের পাখার মায়াবী হিন্দোল, নিদাঘ দুপুরে টলটলে পুকুর জলে জলমাকড়শার হিজিবিজি।
কিংবা, ঘোর কৈশোরে পাড়াতুতো কিশোরীর কাজলকালো আড়চোখের চাহনি, আর রঙিন ফিতের আদরে বাঁধা বিনুনির আলোড়ন! শুনশান দুপুরে সকলের অলক্ষ্যে কোনমতে দু-লাইন লিখেই তাড়াতাড়ি তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়ার হিড়িক … ‘তোমার কাজললতার আকাশ ছুঁয়ে, আমি বৃষ্টি হতে পারি’। তারপর, জীবনের গা বেয়ে কত বানভাসি বৃষ্টিধারা অনর্গল ঝরে গেছে। তবু আমার দেওয়া সেই বৃষ্টিবিন্দুর দাগ, তাঁর কাজললতার আকাশে কোথাও নিশ্চয় আজও লেগে আছে!
যে মানুষটা আরও কিছুটা সময় বেঁচে থাকলে হয়তো জীবনটা অন্য খাতে বয়ে যেতে পারতো। সেই অদমনীয় মানুষটার এই পৃথিবীতে থাকা যখন ক্রমশ দিন থেকে ঘণ্টা, ঘণ্টা থেকে মিনিট, মিনিট থেকে মুহূর্ত হতে থেকেছে, অসহায়ভাবে প্রমাদ গোনা ছাড়া আর কোন্ পথই বা খোলা ছিল! তবু তাঁর চলে যাওয়া তো নিছক একটা মৃত্যু ছিল না। এক সুহৃদ বন্ধু সুদূর কানপুর আইআইটি থেকে চিঠিতে লিখেছিল, “এই চলে যাওয়া আসলে মৃত্যুর কাছে জীবনের গর্বিত নিবেদন”। তাই আজ পর্যন্ত তাঁকে বিদায় জানাতে পারিনি।
এরপর সময়ের ধারা জীবনকে অন্য খাতে অনেকটা দূর পর্যন্ত নিয়ে গেছে। ছাত্র জীবন পার হয়ে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেছি। কর্মসূত্রে তখন নিজ শহরের বাইরে। জরুরি তলবে যখন বাড়ি ফিরলাম, ততক্ষণে তিনি চলেছেন বিসর্জনের পথে। বুকের মাঝে সহস্র কোটি ঢাকের আর্তনাদ। ঠায় দাঁড়িয়ে দেখেছি, গর্ভধারিণী থেকে চিতাভস্মে রূপান্তর, যা গচ্ছিত রাখা আছে এই ধরণীরই বক্ষ মাঝে। তাঁকে বিদায় জানানো যায় নাকি!
জাগতিক নিয়ম মেনে বছর, মাস, দিন, মুহূর্তরা কুলকুল করে বয়ে যায় জীবন নদীর বহমান ধারা বেয়ে। যে ধারা অন্তহীন। যার নির্দিষ্ট কোন সূচনা বা অবসান নেই। তবু মনুশ্য সৃষ্ট কিছু নির্দিষ্ট ক্ষণে, মনে হয় যেন এক পর্যায়ের অন্তে নতুন এক পর্যায়ের সূচনা হল। উল্লাসে মেতে ওঠে মানুষ। অনাবিল খুশির ঢেউ চলকে পড়ে শিশির ভেজা ঘাসের কপালে, পাতার আবেগে, বন-বনাঞ্চলে।
ছেলেবেলায় ফেলে আসা আদিগন্ত চরাচরের নাগাল থেকে আজ আমি অনেকটাই দূরে। বর্ষবরণের জমকালো রাত গর্ভবতী হতেই স্মৃতির কাঁচের বাক্স থেকে গড়িয়ে পড়ে তারা … উদাসী বাউলের একতারার সুরে দুলে ওঠা সেইসব দিনগুলি, রাতগুলি। নিভুনিভু প্রকৃতির আলোর নদীপাড়ে কৃত্রিম আলোর রোশনাই আছড়ে পড়তেই কালের ঢাক বেজে ওঠে দূরে। কারা যেন উল্লাসে ফেটে পড়ে। স্পষ্ট শুনতে পাই নিরন্তর বয়ে যাওয়া নদীর উতলা উচ্ছ্বাস। স্পষ্ট দেখতে পাই, ধুয়ে যাচ্ছে সব … স্মৃতি, কল্পনা, জলছবিতে আটকে থাকা সোনালী সোনালী অতিতের গল্পগাথা। চুরি হয়ে যাচ্ছে, ফেলে আসা দুর্মর সময়ের হাড়-কংকাল। আলোর খুশিতে ম্রিয়মাণ আঁধারের বুকের বাতিল পাঁজর।
হই হই হাসি আর নেশার হুল্লোড়ের মাঝেই কাদের সঙ্গে যেন শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। শুভকামনার কয়েক পশলা বৃষ্টিও ঝরে পড়ে অঝোরে। ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই চোখ মেলে দেখি “শাশ্বত রাত্রির বুকে অনন্ত সূর্যোদয়”। নতুন দিনের ঝকঝকে রোদ্দুর ঝলমল করে ওঠে আধবোজা চোখের লক্ষ তারার অনন্ত আকাশ জুড়ে। চরাচরময় খুঁজে ফিরি, সেই কাজললতার ফেলে আসা আকাশটাকে। সূর্যকণা ঠিকরে এসে চোখ ধাধিয়ে দেয়। হয়তো তাঁরই জন্য আজও নৌকা ভাসাই, বানভাসি রোদ্দুরে!
লেখক অধ্যাপক, সমাজ-রাজনীতি-পরিবেশ বিশ্লেষক