উপমহাদেশের দুই পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ আপাতত স্থগিত বলেই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ততদিনে মানুষের জীবনের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। সবমিলিয়ে দুই দেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ জানা যাচ্ছে প্রায় ৮৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার। ২২ এপ্রিল দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার বৈসরন উপত্যকার পেহেলগামে পর্যটক হত্যা কান্ডের পর এই যুদ্ধোন্মাদনা দেখা দেয়। যদিও গত কয়েক দশকে এই রকম পরিস্থিতি কয়েক বার তৈরি হয়েছে, কিন্তু এবারের প্রেক্ষিত ছিল অন্য ধরনের। শুধু সামরিক বাহিনীর লোকজন নয়, দুই দেশের সরকার ও জনগণের একটা অংশও মনে করল যুদ্ধই একমাত্র পথ। সামাজিক মাধ্যম থেকে গণমাধ্যমও মেতে উঠেছিল এই যুদ্ধোন্মাদনায়, সবাই যেন মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েছিল। সর্বক্ষেত্রে উত্তেজনা, রণহুংকার আর আস্ফালন। সবাই ভুলে গেল যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক বিভীষিকা ও ভয়াবহ পরিণতির কথা।

উল্লেখ্য, এই যুদ্ধের মধ্যে ধর্মীয়করণের একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গেল। দুটি দেশ যুদ্ধের নামকরণে দুই ধর্মের স্পর্শকাতর কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করলো। যাকে অনেকেই ধর্ম যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ায় এক ধরনের অপচেষ্টা বলে মনে করেন। প্রথম থেকেই ধর্মের খাতিরে যুদ্ধ বিষয়টিকে বিষিয়ে তুলে দেওয়া হয়। যদিও আমরা জানি ধর্মের নামে হিংসা আর ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, যুদ্ধ বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে আসলে কোনো ধর্মের কোনো উপকার হয় না। বরং বিশেষ গোষ্ঠী উপকৃত হয়। ১৯৪৬-৪৭ সালের উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সেকথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সরকারি হিসাবে সেই দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ আর বেসরকারি হিসাবে ১২ লাখ। ইতিহাসের ভয়াবহ সেই দাঙ্গায় নিরীহ হিন্দু-মুসলিমের প্রাণ গিয়েছিল, দাঙ্গা যারা বাধিয়েছিল তাদের কিন্তু তেমন কিছু হয়নি।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পেহেলগামে সরাসরি ধর্ম যাচাই করে খুন করা হয়। জম্মু-কাশ্মীরের ইতিহাস ও ভৌগোলিক বাস্তবতায় এলাকাটি অনেক দিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু কীভাবে সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলির নজর এড়িয়ে খুনিরা হত্যালীলা চালালো? এই প্রশ্নও অনেকে করছে, কেবল তাই নয়, জঙ্গি আস্তানার দাবি করে যে সব জায়গায় হামলা চালনো হল, তার থেকেও অনেকের প্রশ্ন, জঙ্গিরা কোথায় থাকে, ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীগুলি কি ঘুমায়, তারা কি কিছুই জানে না? সেক্ষেত্রে হামলার আগে কোনো আভাস না পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। অনেকে বিষয়টির একটি আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন। কিন্তু অবিশ্বাস আর ক্ষোভের বারুদ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে রূপ নেয়। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জঙ্গিরা ইসলামের নাম করে বিশেষ কোনো সুবিধা নেওয়ার জন্য এই হামলা চালিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন, হামলার মাধ্যমে নিরীহ হিন্দু ধর্মাবলম্বি পর্যটকদের হত্যা করে ইসলাম ধর্মের কি কোনো উপকার হল?

ভারতে ১৪০ কোটির দেশে হিন্দু ১০০ কোটির বেশি। হিন্দু হত্যা করে কি ভারতকে হিন্দুশূন্য করা বা অন্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? মুসলিম শাসকরা প্রায় ৫০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করলেও মুসলিম জনসংখ্যা কোনো সময় ১৫ শতাংশের বেশি ছিল না। প্রাচীনকাল থেকে ভারতের অধিকাংশ প্রভাবশালী শাসকরা ছিল বৌদ্ধ, পরবর্তী সময়ে মুসলিম, ইংরেজরা ছিল প্রায় ২০০ বছর। হিন্দু ধর্মের উপর যদি কোনো বিরাট আঘাত আসত তবে হিন্দু ধর্মের টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠত। কিন্তু হিন্দু ধর্ম কি এতটাই দুর্বল? বৌদ্ধ শাসকরা বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েও কিছুই করতে পারেনি। বৌদ্ধ ধর্ম ভারতে উৎপত্তি লাভ করা সত্ত্বেও এই ধর্ম নিজেই এক সময় ভারত থেকে প্রায় শূন্য হয়ে যায়। উপমহাদেশের ধর্মভিত্তিক জনগোষ্ঠী বিবেচনায় দেখা যায়, উপমহাদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। ইসলাম যদি ভারতে তরবারির মাধ্যমে বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সুযোগ-সুবিধার কারণে আসত তাহলে দিল্লি-আগ্রার আশপাশের অঞ্চলগুলি বা মূল ভারত মুসলমান অধ্যুষিত হত, কেননা মুসলিম শাসকরা সেখানে বসে শত শত বছর শাসন করেছে। অন্যদিকে, পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত, জলাভূমি বা বনজঙ্গলে আচ্ছন্ন অঞ্চলে সেই অর্থে সেনা অভিযানের তেমন ঘটনা ঘটেনি; যেখানে তরবারি ছিল অনেক দুর্বল। অথচ সেখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। একইভাবে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল দিল্লি থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও উপজাতি লোকদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে সেখানে মুসলিমের সংখ্যা বেড়ে যায়। আর পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশাল অংশ বিভিন্ন জাট গোত্র থেকে আসার সত্যতা পাওয়া যায়। তাছাড়া এটা ইতিহাস স্বীকৃত যে, আর্য বা ব্রাহ্মণদের আদি নিবাস মধ্য এশিয়া, তারা একসময় ইরান-আফগানিস্তান হয়ে ভারত উপমহাদেশে এসে বিকাশ লাভ করেছে। আর্যরা এসে ভারতের ফাঁকা মাঠ দখল নেয়নি। এখানে জনবসতি ছিল। মুসলিমরাও একইভাবে সেই পথে এসেছে। কেউ আগে আর কেউ পরে। আর আমরা ভারত উপমহাদেশের লোক কেউ মুসলিম হয়েছি আর কেউ হিন্দু হয়েছি। অতএব কেউ কারোর বাড়া ভাতে ছাই দেয়নি।

১৮৮১ সালে বঙ্কিমচন্দ্র এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন স্থানীয় দরিদ্র কৃষক শ্রেণি ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিবেকানন্দও প্রায় একই কথা বলেছেন, ‘অতীতের অনেকে এবং ইদানীংকালের কেউ কেউ মুসলমানদের ‘বিদেশি’ বলে আখ্যাত করে থাকেন। মুসলমান শাসনের প্রথম দিকে যারা ভারত আক্রমণ করেছিল তারা বিদেশি ছিল। তবে তারা ছিল মুষ্টিমেয়। কিন্তু ভারতে লক্ষ লক্ষ যে সাধারণ মুসলমান তারা বহিরাগত ছিল না। আক্রমণকারীও ছিল না। এইসব মুসলমানরা পুরোপুরিই ভারতীয় জনসমাজ-সস্তুত। তারা পুরোপুরিই ভারতীয়।’ তিনি এও বলেছেন, ‘ভারতবর্ষে দরিদ্রদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশি কেন? একথা বলা মূর্খতা যে, তরবারির জোরে তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়। সেইজন্য বাংলাদেশে, যেখানে কৃষকদের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমান বেশি।’

বিবেকানন্দ বলেছিলেন “হিন্দুধর্ম দুটো জিনিস শিখিয়েছে—সহনশীলতা আর বহনশীলতা। শুধু সইব না, সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াব। হিন্দুধর্ম সব ধর্মকে শুধু মেনে নেয় না—টেনেও নেয়। হিন্দুধর্ম এও শেখায় যে সর্বধর্মই সমান মহান।’ বিবেকানন্দের সময় রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছিল এবং ওই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দু ধর্মে দেবমন্দিরের তেমন প্রাধান্য নেই। যদি সব মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়, তাতেও ধর্মের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। আবার ভারতজুড়ে সব মন্দির হলেও ধর্মের কোনো উপকার হবে না। মসজিদ ভেঙে মন্দির উদ্ধার কী যুক্তিযুক্ত? কোন মসজিদের নিচে কী আছে এটা খোঁজাখুঁজি করলে মন্দিরের নিচে কী আছে অন্যদের সেটা দেখার যুক্তিটাও মানতে হয়।’ বিবেকানন্দ একাধিক জায়গায় হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়, প্রেম, প্রীতি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথাবলেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমাদের উপমহাদেশে সন্ন্যাসী, দার্শনিক ও লেখক বিবেকানন্দের মত, বাণী ও আদর্শ সুবিধাবাদীদের কারণে চাপা পড়ছে। এটা লজ্জাজনক, যখন লাশের মিছিলের সবাইকে জঙ্গি বলে উপহাস করা হয়, যেখানে নারী ও শিশুদের লাশ রয়েছে। আবার জঙ্গি তকমা দিয়ে গরিব ও অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। ছিন্নমূল-অসহায় মানুষের কোনো আইডি কার্ড, পাসপোর্ট, দলিল বা পেপার থাকে না, তাদের ধরে এনে অন্য রাষ্ট্রে পুশইন করা হয়। ভারতকে পারমাণবিক বোমা ফেলতে হবে সিন্দু নদীর অববাহিকায় যেখানে হিন্দু ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। অন্য দিকে পাকিস্তানকে বোমা ফেলতে হবে দিল্লি, আগ্রাসহ প্রভৃতি স্থানে যেখানে রয়েছে মুসলিমদের বিভিন্ন নিদর্শন। অর্থাৎ উপমহাদেশের পারমাণবিক যুদ্ধ আত্মঘাতী। ধর্মের নামে অধর্মবিষ, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি, সন্ত্রাস আর স্বার্থ মিশিয়ে যেন তীব্র বিষের রেসিপি।
