সমাজ ও সামাজিক সংস্কার বা আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা প্রায়শই হয়ে থাকে। কিন্তু সাংবাদিক রামমোহন বা তার প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র এবং সেগুলির পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে আলাপ আলোচনায় আমরা একটু কার্পণ্য দেখাই ফলে সাংবাদিক রামমোহনের ভূমিকা একটু আড়ালেই পড়ে থাকে। অথচ সংবাদপত্রের মাধ্যমেই সমাজ পুনর্গঠন ও রেনেসাঁর ক্ষেত্রে রামমোহন এটি বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। একথা বলাই যায় যে রামমোহন সংবাদপত্রের মধ্য দিয়েই সমাজ বিপ্লবের চেষ্টা করেছিলেন। সেই কারণে তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য আজীবন সোচ্চার ছিলেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমেই তিনি সমাজের উচ্চস্তরে সমাজ সংস্কারের বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। তুলে ধরতে চেয়েছিলেন প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র। সমাজের অনিয়ম, অনাচারকে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।

ইংরেজি ভাষার সংবাদ পত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’এর মাধ্যমেই ভারতীয় সাংবাদিকতার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত। ‘A weekly political and commercial paper open to all parties, but influenced by none’। এই ‘বেঙ্গল গেজেট’ই রামমোহনকে সাংবাদিকতায় বলা ভাল সাংবাদিকতার স্বাধীনতা- এই ধারণাকে স্পষ্ট করতে সাহায্য করেছিল। পরে ১৮১৮ সালে প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র বাকিংহাম সম্পাদিত ক্যালকাটা জার্নাল প্রকাশিত হলে রামমোহন সেখানে সহমরণ প্রথার বর্বরতার বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন। রামমোহনের ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ এই পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেই সময়ে আরও কয়েকটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হত; যেমন—বাঙ্গাল গেজেটি, দিগদর্শন, সমাচার দর্পণ ইত্যাদি। সবগুলিই পরবর্তীতে ইতিহাসখ্যাত। মার্শম্যানের সম্পাদনায় হুগলীর শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত ‘সমাচার দর্পণ’-এ রামমোহনের একাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এই পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একেশ্বরবাদী ধর্মভাবনা ও পৌত্তলিকতা বিরোধী মতামত পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তবে কালক্রমে এই পত্রিকার সঙ্গে রামমোহনের চিন্তাভাবনার দূরত্ব তৈরি হওয়ায় তিনি পৃথকভাবে সংবাদপত্র প্রকাশের কথা ভাবেন। রামমোহন ১৮২১ সালে নিজের উদ্যোগে ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি ছিল দ্বিভাষিক অর্থাৎ ইংরেজি ও বাংলা দুটি ভাষায় মুদ্রিত। যদিও এই পত্রিকাটি খুব অল্প কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই রামমোহন ‘সম্বাদ কৌমুদী’-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে যান। ১৮২১ সালের ডিসেম্বরে ‘সম্বাদ কৌমুদী’ প্রকাশ পায় রামমোহন, তারাচাঁদ দত্ত ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে। ‘বাঙ্গাল গেজেটি’-র পর ‘সম্বাদ কৌমুদী’-ই হল বাংলায় সম্পাদিত ও বাঙালি পরিচালিত দ্বিতীয় সংবাদপত্র। পত্রিকাটি বাংলা, হিন্দি ও পার্সিয়ান –এই তিনটি ভাষায় প্রকাশিত হত। এই পত্রিকাটি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল বলে জানা যায়।

প্রসঙ্গত, রামমোহন রায়ের প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা ছিল ১৮০৩ সালে প্রকাশিত ‘তাহাফত-উল-হুয়াহহিদ্দিন’ বা ‘একেশ্বরবাদীদের জন্য প্রদত্ত উপহার’। এই পত্রিকাটি সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে খুবই সরব ছিল। ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত এই পত্রিকাতে সমাজের প্রান্তিক মানুষের চিত্র ফুঠে উঠত। এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে এক ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন রামমোহন রায়। সাপ্তাহিক ‘সম্বাদ কৌমুদী’ ছিল রামমোহন রায়ের দ্বিতীয় পত্রিকা। ১৮২১ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয় এই সাপ্তাহিক। প্রথমে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’র সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেও, তার সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয় রামমোহন রায়ের। কারণ, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন গোঁড়া সমাজের প্রতিনিধি। বিরোধের জের ধরে ৩ মাস পরেই ‘সম্বাদ কৌমুদী’ ছেড়ে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার কলুটোলায় নিজের প্রেস তৈরি করে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’প্রকাশ করতে শুরু করলেন, এই পত্রিকা ছিল রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের মুখপত্র। ভবানীচরণের পর ‘সম্বাদ কৌমুদীর’ সম্পাদকের দায়িত্ব পান রাজা রামমোহন রায়ের ছেলে রাধা প্রসাদ রায়। এই পত্রিকার মধ্য দিয়েই রাজা রামমোহন রায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংবাদপত্রের জগতে প্রবেশ করেন। তখনকার হিন্দু সমাজের কুসংস্কারগুলি দূর করার জন্য সংস্কারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ‘সম্বাদ কৌমুদী’ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

রামমোহন রায়ের তৃতীয় পত্রিকা ছিল ১৮২২ সালে প্রকাশিত ‘মিরাৎ উল্ আখবার’ বা ‘সময়ের দর্পণ’। শিক্ষিত সমাজ যেন দেশের মানুষের কথা অনুধাবন করে, দেশের মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসে, এই পত্রিকার মনোযোগ ছিল সেই দিকে। একইসঙ্গে পত্রিকাটি সাধারণ জনগণের বাস্তব অবস্থার ছবিও তুলে ধরত। ‘মিরাৎ উল্ আখবার’ ছিল প্রকৃত অর্থেই সমাজের দর্পণ। এটি প্রকাশিত হত প্রতি শুক্রবার। রামমোহন রায়ের বাকি দুটি পত্রিকা ছিল ‘জান-ই-জাহাপনামা ও ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’। ‘জান-ই-জাহাপনামা’ প্রকাশিত হত উর্দু ও ফার্সি ভাষায়। আর ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’প্রকাশিত হত চারটি ভাষায়। টানা ১৩ বছর প্রকাশিত হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করলে রামমোহন রায় এই পত্রিকা বন্ধ করে দেন।

সংবাদপত্রের দিকদর্শনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অসামান্য। কেবল একটি ভাষার মধ্যেই আবদ্ধ থাকেননি তিনি। সংস্কৃত থেকে শুরু করে ইংরেজি, বাংলা, আরবি, উর্দু ফার্সি—সব ভাষাতেই সংবাদপত্রের মাধ্যমে বৈপ্লবিক ধারণা প্রচার করতে চেস্টা করেছেন। তিনি ব্রাহ্মধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তার ধ্যান-ধারণা, আত্মিক সংযোগ—সবটা জুড়েই ছিল মানুষ ও মানবিকতা। যে সত্য অনুসন্ধানে আজীবন অনুসন্ধিৎসু ছিলেন, তাঁর প্রকাশমাধ্যম ছিল সংবাদপত্র। ধর্মীয় কুসংস্কার ও নানা ধরনের কুসংস্কার বিলুপ্তির জন্য বড় ভূমিকা রেখেছিল তার প্রকাশিত পত্রিকাগুলি। সবশেষে বলতে হয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আদায়ে রামমোহনের নিরলস সংগ্রাম—যা ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ১৮২৩ সালে অস্থায়ী গভর্নর জন অ্যাডাম কঠোর প্রেস অর্ডিনেন্স জারি করে ভারতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করেন। এর প্রতিবাদে রামমোহন, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও আরও কয়েকজন মিলে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। বিচারপতি সে আবেদন খারিজ করে দিলে তাঁরা ইংল্যান্ডের রাজার কাছে একটি আপিল পাঠান। রামমোহন লিখিত সেই আপিলকে ভারতের ইতিহাসে এক অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সংবাদপত্রের ইতিহাসে তাঁর করা আবেদন স্মরণীয় দিকচিহ্ন হয়ে থাকবে চিরকাল। পঞ্চান্ন পৃষ্ঠার দীর্ঘ আবেদনে মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা কীভাবে অপহৃত হল তার বর্ণনা দিয়ে দমনমূলক আইন প্রয়োগের ফলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে কতটা দূরত্ব তৈরি হতে পারে, তার যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা করা হয়েছে। রামমোহনের এই প্রচেষ্টা ইংল্যান্ডেও সাড়া ফেলেছিল। যদিও সেখানেও এই আবেদন বাতিল হয়ে যায়। তবে রামমোহনের এই লড়াইয়ের ফল পাওয়া গিয়েছে তাঁর প্রয়াণের পর। ১৮৩৮ সালে চার্লস মেটকাফে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার পর সংবাদপত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ বিধি বাতিল করে দেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা একজন ভারতীয় নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার সপক্ষে রামমোহনের এই সংগ্রামকে ভারতের জনগণ চিরকাল কুর্নিশ জানাবে।
