যতজন চিত্রকর পৃথিবীতে তাদের শিল্পকর্ম ও জীবনচর্যার কারণে যুগযুগান্ত ধরে তাদের খ্যাতি এবং জনপ্রিতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন ভ্যান গঘ তাদের মধ্যে অন্যতম। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কয়েকজন জার্মান ঐতিহাসিক ভ্যান গঘের কান কাটার রহস্য উন্মোচন করতে গবেষণা চালিয়েছিলেন। প্রায় দশ বছর গবেষণার পর তাঁরা জানান, ভ্যান গঘ নিজে কান কাটেননি। তাঁর কান কেটেছেন পল গগ্যাঁ। পরে নিজেকে বাঁচাতে গগ্যাঁ সবাইকে বলেছেন, উন্মাদনায় ভ্যান গঘ নিজেই নিজের কান কেটেছেন! সেই দিনটি ছিলো ২৩ ডিসেম্বর। এর উলটো কথা বলেন ‘স্টুডিও অব দ্য সাউথঃ ভ্যান গঘ প্রভেন্স’-এর লেখক মার্টিন বেলি। তার বক্তব্য অনুযায়ী ভাই থিওর বিয়ের কথা শুনে বিচলিত ও বিষণ্ণ ভ্যান গঘ ১৯৮৮-র ২৩ ডিসেম্বর নিজেই নিজের কানের লতি কেটে ফেলেছিলেন। ঘটনা যাই ঘটুক না কেন আসল কথা হল কেবল তাঁর সময় নয় ভ্যান গঘ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীদের অন্যতম, এখনও তাঁকে ঘিরে উৎসাহের অন্ত নেই।
শিল্পের ইতিহাস নাড়াঘাঁটা করেন লেখক মার্টিন বেলি। তার নতুন বই ‘স্টুডিও অব দ্য সাউথ: ভ্যান গঘ ইন প্রভেন্স’-এ সম্প্রতি দাবি করেছেন, নিজের ভাই থিওর বিয়ের কথা শুনে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন ভ্যান গঘ। তার পরেই ১৮৮৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কান কেটে ফেলেন এ শিল্পী। মার্টিন বেলি মনে করেন, নিজের অন্যতম বিশ্বস্ত সঙ্গী থিওর বিয়ের খবরে চিন্তায় পড়ে যান গঘ। থিওর কাছে থেকে পাওয়া আর্থিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করেই নিশ্চিন্তে ছবি আঁকতেন তিনি। গঘকে তখনও কেউ চেনেই না সেভাবে। ছবি বেচে রোজগারের প্রশ্নই নেই।
বেলির গবেষণা অনুযায়ী, ভাই বিয়ে করলে শিল্পচর্চার কী হবে, তা নিয়ে দারুণ উদ্বেগ তৈরি হয় গঘের মনে। সেই সময়ে গঘ পরিবারের মধ্যে যে সব চিঠি চালাচালি হয়েছিল, (এতদিন সেগুলি অপ্রকাশিত ছিল) সেগুলি ঘেঁটেই এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছান বেলি।
১৮৮৮ সালের ২৩ ডিসেম্বরের রবিবার থিওর কাছ থেকে একটা চিঠি পান ভ্যান গঘ। সঙ্গে ছিল একশো ফ্রাঁ। চিঠিতে লেখা ছিল, দিন পনেরো আগে পুরনো বান্ধবী জো বঙ্গারের সঙ্গে দেখা হয়েছে থিও-র। জো এক সময় থিওকে প্রেমে ফিরিয়ে দিলেও, এ বার বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছেন!
সেই ২৩ ডিসেম্বর গোটা দিনটা বন্ধু গগ্যাঁর সঙ্গে ছবি আঁকা নিয়েই মগ্ন ছিলেন গঘ। বৃষ্টি ছিল সারা দিন। রাত ঘনাতেই গঘের বাড়ি ছেড়ে প্যারিস চলে যাওয়ার হুমকি দেন গগ্যাঁ।
গবেষক বেলি বলছেন, এর পরে গগ্যাঁর সঙ্গে তর্কাতর্কি হলেও তার কারণটা আসলে থিও-র চিঠির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে।
থিও ওই সময়েই বিয়ের জন্য মায়ের কাছে অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। থিওর প্রেমিকা জো লিখেছিলেন তাঁর বড় ভাইকে।
বেলি নিশ্চিত, থিও তাঁর প্রেমিকার মতো নিজের ভাইকে খবরটা দিতে চেয়েছিলেন। ফ্রান্সের আর্ল-এর বিখ্যাত ‘ইয়েলো হাউস’-এ সেই চিঠিটি এসে পৌঁছনোর কিছু সময় পরেই ভ্যান গঘ কেটে ফেলেন নিজের কান।
ক্ষুরের ধারে বাঁ কান কেটে রক্তে ভেসে গেলেও কাটা কানের টুকরো কাগজে মুড়ে চেনা যৌনপল্লিতে পৌঁছে যান শিল্পী। সেখানে এক তরুণীকে দেন সেই কান। বার্নাডেট মার্ফির লেখা আর একটি বই অবশ্য দাবি করে, গঘ কোনো যৌনপল্লিতে যাননি। স্থানীয় এক কৃষকের মেয়েকে দিয়েছিলেন ওই কান। মার্ফি আবার এর সমর্থনে এক চিকিৎসকের আঁকা একটি ছবির কথা বলেন। তার পরের ঘটনা অবশ্য সবার জানা। ওই তরুণী কাগজ খুলে কানের টুকরো দেখে মূর্চ্ছা যান। ভ্যান গঘ পালিয়ে যান সেখান থেকে। পরে পুলিশ আসে।
পর দিন গঘের বাড়িতে চলে আসেন গগ্যাঁ। দেখেন দোরগোড়ায় পুলিশ। রক্তে ভেজা বিছানায় পড়ে আছেন গঘ। ভাই থিও নিজের প্রেমিকার সঙ্গে বড়দিন কাটাবেন ভেবেও ভাইয়ের কথা শুনে ছুটে আসেন আর্ল-এর হাসপাতালে।
পরের বছর ৭ জানুয়ারি ছাড়া পান ভ্যান গঘ। তার পরে ভাইকে চিঠিতে শিল্পী লেখেন, ‘ভালো দিন আসবে খুব শিগগির। আমি আবার শুরু করব।’
এর পরে বেশ কয়েক বার অসুস্থতা সত্ত্বেও ছবিকে ছাড়েননি গঘ। এপ্রিলে আর্ল ছেড়ে চলে যান তিনি। তবে এই সংকটের সময়ে আঁকা বিভিন্ন ছবি শিল্পীর সেরা সৃষ্টির মধ্যে গণ্য করা হয়।