ফুল্লরাপীঠের একটু আগেই ডান পাশে চলে গিয়েছে পিচের রাস্তা। কিছুটা যাওয়ার পর গ্রামের কাঁচা রাস্তা। প্রত্যন্ত গ্রাম। দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। বীরভূমের লাভপুর থানার অন্তর্ভূক্ত এই গ্রামটির নাম শীতলগ্রাম। এই গ্রামের শতকরা কুড়ি শতাংশ মানুষ বাজিকর সম্প্রদায়ের। বাজিকর সম্প্রদায়ের পুরুষরা বহুরূপী সেজে, বাজি দেখিয়ে এবং মহিলারা হাবুা গান করে সংসার নির্বাহ করেন। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘যাদুকরী’ ছোটগল্পটিতে শীতলগ্রাম তথা সিদ্ধল গ্রামে বাজিকর সম্প্রদায়ের মানুষদের কথার উল্লেখ রয়েছে। এ গ্রামেও দুর্গা পুজো হয়। শীতলগ্রামের বাজিকর সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্যোগে এই দুর্গাপুজো ঐতিহ্যপূর্ণ তো বটেই তাছাড়া প্রতিবছর এই পুজোয় বিস্ময়কর ঘটনা দিয়েই শুরু হয় দেবী দুর্গার অষ্টমী পুজোর আয়োজন।

সারাটা বছর বাজিকর সম্প্রদায়ের পুরুষরা বহুরূপী সেজে বিভিন্ন গ্রামে যাযাবরদের মতো ঘুরে ঘুরে নানান ধরনের বাজির খেলা দেখান। কষ্টের উপার্জন তাঁদের। সেই কষ্টার্জিত অর্থে সংসার চালিয়ে সকলেই সঞ্চয় করেন কিছু অর্থ। সেই অর্থ দিয়েই তাঁরা আয়োজন করেন শারদীয়া উৎসব। ছোট্ট টিনের চালার মন্দির। সামনে দাওয়া। মন্দিরের বাঁ পাশে তৈরি হয়েছে বিশাল শিবমন্দির। তার পাশে আর একটি মন্দির। এটি বাগদিদের দুর্গামন্দির। তাদের উদ্যোগে দুর্গা পুজো হয় ফি বছর। এই গ্রামে মায়ের থানে ছিটিয়ে দেওয়া হয় সিঁদুর। তার ওপরে পেতে দেওয়া হয় নতুন সাদা কাপড়। এর পর গ্রামের বাজিকররা দেবী দুর্গার উদ্দেশ্যে সমবেতভাবে আহ্বান জানান আকুল হয়ে। ক্রমাগত প্রার্থনায় দেবী দুর্গার সাড়া মেলে। এক সময় তাঁদেরই চোখের সামনে দেবীর পায়ের ছাপ ফুটে ওঠে সাদা কাপড়ে। তারপরই শুরু হয় সন্ধিপুজো। বিজ্ঞানের যুগে এমন ঘটনা অতীতে ঘটেছে, আজও ঘটে। এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায় প্রতি বছর মহাষ্টমী তিথিতে।

শীতলগ্রামের বাজিকর সম্প্রদায়ের দুর্গাপুজোর মন্ত্র সংস্কৃত নয়, বাংলাতে পুজোর মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। এখানে দুর্গাপুজোয় সন্ধ্যারতি হয় না। শীতলগ্রামে বাজিকরদের দুর্গাপুজোতে অষ্টমীর দিন মায়ের পদচিহ্ন পড়ে এবং মায়ের পদচিহ্ন দেখার জন্য জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন আসেন। এর থেকেও বড় কথা অন্যান্য দুর্গা পুজোর পুরোহিত যেখানে ব্রাহ্মণ সেখানে শীতলগ্রামের বাজিকরদের দুর্গাপুজোর পুরোহিত কোনো ব্রাহ্মণ নয়, অব্রাহ্মণ। বাজিকর সম্প্রদায়েরই কয়েকটি পরিবারের লোকজন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শীতলগ্রামে বাজিকরদের দুর্গাপুজো করে আসছেন। শীতলগ্রামে বাজিকরদের দুর্গাপুজোর পুরোহিতকে দক্ষিণা দানের ক্ষেত্রেও নিজেদের ইচ্ছে মতো দক্ষিণা দিয়ে থাকেন বাজিকরেরা। এমনকি শীতলগ্রামের বাজিকরদের দুর্গাপুজোয় সঙ সেজে গ্রাম পরিক্রমা করার একটি চল রয়েছে।

১৫০ বছর আগে সুদূর ওড়িশা থেকে শীতল গ্রামে বাজিগরদের নিয়ে এসেছিলেন জমিদাররা। সারাবছর নিজেরা রং মেখে সেজে অন্যদের আনন্দ দিয়ে থাকেন।পরিবারের লোকেদের আনন্দ প্রদান করার জন্য ছিল এই ব্যবস্থা। আর তারপর থেকেই ধীরে ধীরে এখানে বসবাস শুরু করেন বাজিগর সম্প্রদায়ের মানুষজনেরা। বর্তমানে এই গ্রামে বাজিগর সম্প্রদায়ের প্রায় ৫০ টি পরিবারের বসবাস। জমিদার পরিবারের সদস্যদের তখন বাঁশের উপর উঠে খেলা দেখানো, হাবু গান করা ও বহুরূপী সেজে সং দেখানো ছিল তাদের মূল কাজ। কিন্তু পুজো কয়েকদিন তারা সাজান মা কে। বর্তমানে গ্রামে জমিদার নেই। পুজো করেন বাজিগররা। এখানে সিংহের পরিবর্তে থাকে নরসিংহ। অষ্টমী পূজোর দিন মায়ের সামনে রেখে দেওয়া হয় সিঁদুর, আর সেই সিঁদদুরের ওপরই নাকি দেখা যায় মায়ের পদচিহ্ন। তারপরই হয় মহাষ্টমী পুজো ও বলিদান।

সারাবছর রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় তারা নানান রূপে সেজে, গান করে রুটি রোজগার করেন। কিন্তু সারাবছর তারা যে যেখানেই থাকুক না কেন ফিরে আসেন দুর্গা পুজোতে, নিজের গ্রামের বাড়িতে। আর এই পুজোর কয়েকদিন তারা নিজেরা কোনো সাজে সাজেন না, সাজান মা দুর্গাকে। আর পুজো করেন তারা নিজেরাই। অষ্টমী পূজোর দিন মায়ের সামনে রেখে দেওয়া হয় সিন্দুর, আর সেই সিন্দুরের ওপরই নাকি দেখা যায় মায়ের পদচিহ্ন। তারপরই হয় মহাষ্টমী পূজা ও বলিদান।