প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগের কথা। সে কি হুলস্থুল কান্ড দামোদরের চরকে ঘিরে। এবার নাকি ওপারের কাছি বা কিনারায় বেরিয়েছে চন্দ্রধর বনিক ওরফে চাঁদ বেনের ডিঙি। ডিঙির বিশাল কাঠামো, মাস্তুল আর মরচেহীন নোঙরকে ঘিরে ছড়িয়েছে চাঞ্চল্য। প্রথমে আর পাঁচটা খবরের মতোই ‘সাইডস্টোরি’ হিসেবে রেখে দিলাম। তবুও কৌতুহল মেটাতে এপার ওপার মিলে দশ বিশ’টা ফোন সেরে নিলাম। ততক্ষণে রাধামোহনপুরের জয়দেব উত্তেজিত হয়ে ফোন করেছে। আমাদের অতি প্রিয়জন এই প্রান্তভূমির কথাকার জয়দেব। তাঁর অনুযোগ, সবাই আসছে দেখতে আর আপনি আসবেন না? কথা দিলাম তাঁকে। এরই মাঝে অনেকগুলো ছবি এসে গেছে মোবাইল মারফত। সোনামুখী থানার বড়বাবুর পাঠানো নোঙরের ছবিটা ভীষনভাবে আকৃষ্ট করলো আমাকে। প্রথমত মরচে ধরেনি একটুও, চকচক করছে। দ্বিতীয়ত নোঙরের মাথায় মাখানো সিঁদুর এখনো রয়েছে অবিকল ভাবে।
পরদিন সাতসকালেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাধামোহনপুরের উদ্দেশ্যে। সময়টা অক্টোবরের মাঝামাঝি। চারিদিকে পূজা পূজা ভাব। শারদ প্রাতে সেজে উঠেছে পল্লী প্রকৃতি। হরেক রঙের শাপলা, পদ্ম মাথা ঝাঁকিয়ে চলেছে পুকুর জলাশয়গুলোতে। কাশের বন সাদরে ডাকছে মানুষকে। উপরে পেঁজা তুলো আর নিচে ধবধবে সাদা কাশের মিছিলে ডুবে যাই আমি। শরতের নরম হাওয়া কাশের মাথায় চুমু এঁকে চলেছে। গায়ে শিরশিরানি ধরিয়ে যায় এই হাওয়া।
সোনামুখী চেলমোড় ছাড়িয়ে চৌমাথা হয়ে উত্তরমুখী রাস্তা ধরে চলেছি ‘শ্লো মোডে’। ছোট মাঝারি যানবাহনের পাশাপাশি মালবাহী ট্রাকটরের আনাগোনা ভয় ধরায় মনে। বড়ই সরু রাস্তা শালী নদীর ঘাট পর্যন্ত। সেকেলে রাস্তা। কলিঙ্গ অবধি বিস্তার এই সড়ক পথটির। ধীরে সুস্থে শালি নদীর সেতু ডিঙিয়ে এসে পৌঁছালাম নফরডাঙা, বোন্দলহাটী গ্ৰামে। উত্তরমুখী রাস্তা সোজা চলে গেছে ধুলাই, রাঙামাটি ও ডি’পাড়ার দিকে। নফরডাঙার বিখ্যাত মেলায় এসেছি দু’একবার। আবার সুদূর অতীতের ‘বন্দ্যোঘাটী’ গ্ৰামের মিসিং লিঙ্ক খুঁজতে এসেছিলাম এখানে। অনেক ঐতিহাসিক তথ্য মিলেছে এই ভূখণ্ড থেকে। সাত থেকে আট শতক এমনকি এগারো-বারো শতকেও সোনামুখী-সহ লাগোয়া অঞ্চল ছিল গৌরবের। শীর্ণকায়া শালি ও দামোদর উপত্যকা জুড়ে গড়ে উঠেছিল কৃষি ও শিল্প সংস্কৃতির পীঠস্থান। উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল প্রতিটি জনপদে। আজও তার সাক্ষী বহন করে চলেছে আমাদের জন্য।
ডানদিক চেপে শুভঙ্কর সরনি ধরে চার পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে উত্তর পূর্বমুখী সাবেক আমলের সড়ক ধরে চলেছি স্নিগ্ধ সবুজের আদর গায়ে মেখে। চারিদিকে শুধু সবুজ মাঠ আর ফসলের সমারোহ। সবুজ প্রান্তভূমির বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলে গেছে দামোদরের ক্যানেল। রাস্তার দুপাশে সাবেক ধাঁচের গাছপালার বদলে ঠাঁই নিয়েছে সামাজিক বনসৃজনের গাছ। শুধু দু’একটি বট, অশ্বত্থ কিম্বা কদম গাছ নজরে পড়ে। এলাকার মানুষ নিজেদের তাগিদে দু’চারটে সাবেক গাছ লাগিয়েছে। দেখতে দেখতে চলে এলাম জয়দেবের বাড়ি। সে প্রস্তুতি নিয়েই বসেছিল রাস্তার ধারের ঠেকে। তাঁর বাড়ি ছুঁয়ে চলে এলাম দামোদরের ঘাটে। নদের দুই পার মানাচরের আওতায় পড়ে। পরিচিত এক বাসিন্দার গাছের তলায় বাইক রেখে চললাম নৌকা ঘাটের দিকে। আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন চন্দনদা। শিক্ষক ও সাহিত্যসেবী। লেখার হাতটি ভীষন ভালো। ওঁরা একসঙ্গেই নিবিষ্ট মনে সাহিত্য চর্চা করেন। কথা বলতে বলতে নৌকায় চড়ে বসলাম।
বেশ বড় ডিঙি নৌকাখানি। সাইকেল, বাইক, সবজির চোপড়া, ঝাঁকা নিয়ে উঠছে সবাই। ওপারের বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে ওরা। বাজার বলতে পানাগড়, বুদবুদ, গলসি আর পারাজ। আরও একটু বেশি দরকার পড়লে দুর্গাপুর, মানকর কিম্বা বর্ধমানে যাবে। হেলতে দুলতে ডিঙি চলেছে দামোদরের বুক চিরে। বর্ষা বিদেয় নিলেও জল রয়েছে অনেকটাই। সাকুল্যে হাজার মিটার জল ঠেঙিয়ে নামতে হবে বালির চড়ায়। কাশ আর শরের বন চিরে শুঁড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা। জুতো হাতে নিয়েও খালি পায়ে হাঁটা যাচ্ছে না। পা ডুবে যাচ্ছে নরম ও পুরু বালিতে। কাশের গোড়ায় পা পড়লে কাঁটার মতো ফুটছে পায়ে। স্থানে স্থানে গভীর অগভীর গর্ত হয়েছে নির্বিচারে বালি তুলে নেওয়ার জন্য। কিলোমিটার খানেক বালিয়াড়ি মাড়িয়ে আমরা পৌঁছালাম অকুস্থলে। এরই মধ্যে ভিড় জমেছে নজর কাড়া। নদীর চরে এবং তীরে প্রচুর মানুষের ভিড় জমে গেছে।
বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসছেন পরম কৌতুহল নিয়ে। তারমধ্যে কমবয়সীদের চলছে সেলফি তোলার ধুম। রিকশা, মোটর ভ্যান আর ছোট গাড়িতে করে মানুষজন আসছেন গ্ৰাম গঞ্জ ও শহর থেকে। একই সঙ্গে ঘুরে যাচ্ছেন কসবা চম্পকনগরী। চাঁদ সওদাগরের আরাধ্য বলে কথিত রামেশ্বর-বানেশ্বর-এর পূজাও দিচ্ছেন অনেকেই। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন স্থানীয় এক যুবক। পেশায় তিনি গ্ৰামীন পুলিশ। বিশেষজ্ঞ বলে যাদের আসার কথা ছিল পরিদর্শন ও সমীক্ষার কাজে তারা একদল ঘুরে গেছেন সকাল সকাল। আর একদল আসবেন বিকেলের দিকে। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি সোনামুখী থানার পূর্ব নবাসন গ্ৰাম পঞ্চায়েতের উত্তর পুরশুড়া মৌজায়। নদের এপারের বেশ কিছু মৌজা ও মানাচর এলাকা বাঁকুড়া জেলার আওতাধীন। পুরশুড়ার পরই কসবা মানা, পূর্ব বর্ধমানের এলাকাভুক্ত। ক্রমশ পাড় ভাঙতে ভাঙতে চর এলাকা মায় উর্বর চাষের জমি ফি বছর দামোদরের গর্ভে চলে যাচ্ছে। দামোদরের কিনারায় বসতবাড়ি রয়েছে বেশ কয়েক ঘর মানুষের। প্রথম নজরে আসে পাড়ের বাসিন্দা দুলাল পান্ডে সহ আরও কয়েকজনের বসতবাড়ি। দুলাল বাবুর বাড়িতেই নোঙরখানি উদ্ধার করে তুলসীতলায় রাখা হয়। শুরু হয়ে যায় পূজা পাঠ। পরে প্রশাসন নিয়ে যায় নোঙরটি।
দুলালবাবুদের বাড়ি ঘুরে অন্য অভিজ্ঞতা হলো আমাদের। কি স্নিগ্ধ ও মনোরম পরিবেশ। তার বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে কসবা চম্পকনগরীর দিকে। এই নৌকার হদিস মিলতেই এখানে শুরু হয়ে গেলো ভিড়। একদিকে মঙ্গলকাব্যে আসক্ত ভক্তপ্রবর অগণিত মানুষ অন্যদিকে বনিক কুলের চূড়ামনি ও সম্পদশালী চাঁদ সওদাগরের ধন সম্পদ ভর্তি ডিঙির টানে দিনরাত পড়ে রয়েছে একদল মানুষ। এই ভাবেই গুজবের ডালপালা ছড়িয়েছে চারিদিকে। বালিতে ভর্তি জলে ডুবে থাকা ডিঙিকে তুলতেও মরীয়া হয়ে উঠেছিল একদল মানুষ। আবার কেউ কেউ স্মারক হিসেবে ডিঙির কাঠ নিয়ে যাচ্ছে ভেঙে ভেঙে। লোহা, কাঠের খিলানের টুকরো-সহ যা পাচ্ছে তাই নিয়ে চলে যাচ্ছে বাড়ি। ঝক্কি ঝামেলা কাটিয়ে আমরা শুরু করলাম আমাদের নিজের মতো করে পর্যবেক্ষণের কাজ। ভিড় সরিয়ে ফিতে দিয়ে ডিঙির মাপজোক শুরু করালাম। আমাদের কাজে সহায়ক হিসেবে হাজির হয়েছেন স্থানীয় এক প্রবীন আসবাবপত্র নির্মানকারী। ডিঙির আয়তন দেখেই বোঝা যায় এটি সাবেক আমলের মালবাহী নৌকা। লম্বা, চওড়া ও উচ্চতা সেই কথাই প্রমান করে।
ডিঙিটির বয়স, নির্মানকাল বা তার প্রাচীনত্ব বলতে পারলেন না প্রবীন মানুষটি। তবে ডিঙির গঠন, নির্মানশৈলী, পাটাতন বা কাঠের চরিত্র এবং নকশা দেখে তার প্রাচীনত্বের একটি ধারণা দিলেন আমাদের। মাস্তুল, দাঁড়ের বাজু কিম্বা বৈঠার কাঠ পরীক্ষাও করলেন আমাদের সামনে। দীর্ঘক্ষণ ধরে আমাদের পর্যবেক্ষণের দরুন আরও ভিড় জমতে লাগলো। বেলা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টান পড়েছে পেটে। পাড়ের বাসিন্দা রায় পরিবারের নিকোনো উঠোনে এসে বসলাম তিনজনে। আতিথেয়তায় মুগ্ধ আমরা। সারি সারি গন্ধরাজ লেবুর গাছ-সহ জবা ও অন্যান্য ফলফুলে ভরা বাগান। মন চাইছে না ছেড়ে যেতে। এরই মধ্যে দু’চারজন বাসিন্দার দাবী, আপনারা একটু সচেষ্ট হোন। এখুনি প্রশাসন উদ্ধার করে না নিয়ে গেলে আমাদের সমূহ বিপদ। আমরাও একই মত প্রকাশ করায় তারা আশ্বস্ত হলেন।
ইলামবাজার থেকে আসা উৎসাহী যুবক আমাদের কাছে জানতে চাইলো, আমরা কসবা চম্পকনগরী যেতে চাই কিনা। আমাদের তিনজনেরই ঘোরা আছে জেনে ছেলেটি একটু নিরুৎসাহিত হলো। আমরা এবার পিঠটান দিতে শুরু করলাম। মাথার উপর সূর্য। তখনও থিকথিকে ভিড় রয়েছে ‘চাঁদ বেনের ডিঙি’ ঘিরে। ক্রমশ বালিয়াড়ি ভেঙে ফিরে চলেছি নৌকা ঘাটের দিকে। মুহুর্তগুলো ধরা পড়ে চলেছে মোবাইলের ছোট্ট লেন্সে। হাঁটতে হাঁটতে পরবর্তী প্রোগ্ৰাম হয়ে গেল আমাদের -চন্দ্রদ্বীপ বা চাঁদ বেনের দহ ঘোরার। নদের বুকে আজও একটি দহ এবং ঢিবি কে ঘিরে চাঁদ সওদাগর সম্পর্কিত মিথ চালু আছে এই এলাকায়। দহের জলে স্নান সেরে তাঁর পরম আরাধ্য শিবের উপাসনা শেষে ফিরতেন চম্পকনগরীর বাড়িতে। নদের বুকে ও দুই পাড়ে জমে আছে তার কত ইতিহাস। জনপদ জুড়ে আজও রয়েছে মঙ্গলকাব্যের কাহিনী কিম্বদন্তী। রাধামোহনপুর, উত্তরবেশিয়া ঘুরে চললাম রামপুর, মদনপুর, রাঙামাটি, ডি’পাড়া ছাড়িয়ে পোখন্না, পলাশডাঙার সাবেক রাস্তায়। দামোদর চরের এই শান্ত নিরিবিলি পল্লীগুলো যেন মানব সংস্কৃতির ত্রিবেনী সঙ্গম। ইতিহাসের কালাধার। পল্লীগুলোর চন্ডীমন্ডপ ঘিরে সেই চির চেনা ছবি মুগ্ধ করে আমাদের। সারল্যে ভরা জীবন বোধ কর্ম সংস্কৃতিকে মহীয়ান করে চলেছে আজও।