সারা বছর নিঝুম থাকলেও বছর শেষের এই কটা দিন এক অন্য আনন্দে মেতে ওঠে বৌবাজারের ছোট্ট এই পাড়াটা। আলো, ক্রিসমাস ক্যারল, খাওয়াদাওয়া আর প্রিয়জনের বাড়ি ফেরার আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লাল বাড়িগুলি। উৎসবের মেজাজ আর থিক থিকে ভিড়ে ছন্দে ফেরে বো ব্যারাক। পার্টি, পিকনিক, খাওয়া দাওয়ায় যতই বৈচিত্র্য আসুক না কেন এখানকার ঐতিহ্যে ভাঁটা পড়েনি। তবে জেন ওয়াই আর ফটোগ্রাফারদের ভিড় থাকে।
প্রতিবছর বড়দিনে শহরের আমোদপ্রেমীরা নানা জায়গাতেই ভীর জমায় তবে বহুকাল ধরেই অন্যতম ‘ডেস্টিনেশন’ এই কলোনি। বড়দিন উপলক্ষে ক্রিসমাস ট্রি, সান্তাক্লজ, রং-বেরঙের বেলুন, তারা, আলোর মালায় ঝলমল করে ওঠে সারাবছর নিঝুম থাকা বো ব্যারাক। ভিনদেশি গানের সুর ঝংকারে চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বড়দিনে এই পাড়ার প্রবাসীরা ফিরে আসেন ঘরে। সকলকে নিয়েই নিজেদের মতো করে বড়দিন উদযাপনে মেতে ওঠেন বাসিন্দারা।
বড়দিন আর বর্ষবরণের আবহে বো ব্যারাকে যে বিশেষ উত্সব শুরু হয় ঘরে তৈরি ওয়াইন সেখানে পরম সমাদৃত৷ প্রাচীন এই অ্যাংলোইন্ডিয়ান পাড়ায় এখনও অনেকে ঘরেই ওয়াইন তৈরির ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন।নভেম্বর মাসের শুরুতে ওয়াইন তৈরির হিড়িক পড়ে যায় অনেক বাড়িতে৷ যথা সম্ভব ভালো মানের মিষ্টি আঙুর কিনে সেই আঙুরের রস তৈরি করে ওয়াইন তৈরির তোড়জোড় শুরু করেন এখানকার বাসিন্দারা৷ বড়দিন ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসব লাল ওয়াইনের সঙ্গত ছাড়া একেবারেই অপূর্ণ৷
লন্ডন শহরের একটি রাস্তার নাম বো স্ট্রিট। সেই নামেই কলকাতার একটি কলোনির নাম বো ব্যারাক।কিন্তু কেন? কারণ, এই রাস্তা যাঁরা তৈরি করেছিলেন তাঁরা আদতে সেখানকারই মানুষই। বিশ্বযুদ্ধে যে আমেরিকান সেনারা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের একসঙ্গে রাখার জন্য এই রাস্তার দুপাশে গড়ে তোলা হয়েছিল বিরাট বিরাট একটানা কয়েকটি বাড়ি। সেনাবাহিনীর পরিভাষায় যাকে বলে ব্যারাক। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। আমেরিকান সেনারা দেশ ছাড়লো, তার পরে পরেই এ দেশ ছেড়ে বিদায় নিতে হল ব্রিটিশদের। ফাঁকা পড়ে রইল ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের তৈরি করা বিরাট আকৃতির বাড়িগুলি। তখন সেই পড়ে থাকা বাড়িগুলিতে আস্তানা গাড়লেন কলকাতাতে জন্ম নেওয়া কিছু সাহেব-মেমরা, যাদের খাঁটি সাহেবরা কোনও দিনই নিজেদের আত্মীয় বলে মেনে নেননি। আমরা তাদের চিনে এসেছি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বলে। তারা কালো চামড়া কিংবা সাদা চামড়া কোনও দলেই নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন না, তাঁরা এই গণ্ডিটুকুর মধ্যে জিইয়ে রাখলেন নিজেদের সংস্কৃতি।
বড়দিনে আজও সেই গলিতে নেমে আসেন ঈশ্বরপুত্র। রাস্তাজোড়া আলোর সাজে, বাড়িতে বানানো কেক, পেস্ট্রি, ওয়াইনে যিশুকে স্বাগত জানায় বো ব্যারাক। বড়দিনের দুদিন আগে থেকেই রাতভর গানবাজনা চলে। সেই ‘মিউজিক্যাল নাইট’-এ বো ব্যারাকের তরুণদের নিজস্ব ব্যান্ডের পারফরম্যান্স চলে। পার্ক স্ট্রিটের সাহেবিয়ানার পাশাপাশি এই মহল্লার মাটিছোঁয়া উৎসবের স্বাদ পেতে ভিড় জমায় কলকাতার আমোদপ্রেমী মানুষ।
সারিবদ্ধ বাড়িগুলো এখনও টিকে রয়েছে বটে, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের বালাই নেই। ভাড়ার প্রশ্নও নেই। সরকার বাড়িগুলি ভেঙে ফেলে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু এলাকার বাসিন্দারা তাতে রাজি হননি। পায়রার খোপের মতো ছোট ছোট ফ্ল্যাটগুলিতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়ে গিয়েছে ১৩০-১৩২টা পরিবার। আর নিয়েই এই কলকাতার মধ্যে বেঁচে রয়েছে আরেকটা কলকাতা। একদা বাংলার হকি মাঠের চ্যাম্পিয়ন সাসেলি সেভিয়েল, ফ্রেডেরিক রোজারিওদের দেখা মিলত এখানে। যেমন খেলাপাগল, তেমনই সুরারসিক। আবার এই তল্লাটকে এক দিন গোটা দেশ চিনত সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়, সিপিআই নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের ঠিকানা হিসেবে। লাল ইটের বাড়িগুলি যেমন ব্রিটিশ কোলনিয়ালিজমের সাক্ষী হয়ে রয়ে গিয়েছে, তেমনি রসগোল্লার শহরে আজও বুক চিতিয়ে রয়ে গেছে ছানার কেক।