পাঁচ মাসের মধ্যে লিখে দিতে হবে ৬০ হাজার শব্দের একটি নতুন উপন্যাস-  বিনিময়ে প্রকাশক লেখককে তিন হাজার রুবল আগাম দিলেন, স্ট্যাম্প আঁটা কাগজে লিখিয়েও নিলেন, যদি না লিখে দিতে পারেন তাহলে লেখকের অতীতে লেখা এবং ভবিষ্যতে যত লিখবেন সমস্তরই আইনসম্মত মালিক হবেন সেই প্রকাশক। কিন্তু ধার দেনা শোধ করতেই আগাম টাকা দ্রুত ফুরিয়ে গেল। এদিকে চুক্তির মেয়াদ প্রায় শেষ। বন্ধুরা তাঁকে মনে করিয়ে দেয়, এমনকি তিনভাগ করে তিনবন্ধু লিখবেন এমন প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু লেখক সে প্রস্তাব মানতে নারাজ। অবশেষে বন্ধুদের পরামর্শে স্টেনোগ্রাফার রাখলেন।  

নির্দিষ্ট সময়ে তরুণী স্টেনোগ্রাফার এলেও প্রথম দিন উপন্যাস লেখার কোনো কাজ হল না। আসলে লেখক নিজেই সন্দিহান ছিলেন যে এইভাবে কোনো উপন্যাস লেখা যায় কি না। তাছাড়া তিনি মেয়েটিকে যাচাই করতেও চেষ্টা করেন। কথোকথনের শুরুতেই লেখক জানান যে তিনি মৃগিরোগী। এরপর তিনি ঘরের এ দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল অনবরত পায়চারি করতে থাকেন আর সিগারেট টেনে চলেন। এক সময় মেয়েটির শর্টহ্যান্ডের গতি পরীক্ষা করতে তিনি খুব দ্রুত পড়ে যাচ্ছিলেন, মেয়েটি তখন লেখককে স্বাভাবিক গতিতে পড়তে বলেন। শর্টহ্যান্ডে লেখার পরে মেয়েটি সেটাকে আবার পূর্ণাঙ্গ গদ্যে রূপান্তর করলেন। লেখক পরীক্ষা করে দেখলেন যে মেয়েটি একটি দাঁড়ি বাদ দিয়েছেন, আর একটি অক্ষর পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না।

এই ভুলের জন্য লেখক মেয়েটিকে যথেষ্ট বকাবকি করলে তিনি অপমানিত হন কিন্তু কাজটি ছাড়েন না। তবে পুনর্লিখনের কাজটি তিনি রাতে বাড়িতে করবেন বলে জানান। লেখকও তাঁর স্টেনোগ্রাফারকে প্রকাশকের সঙ্গে তাঁর চুক্তির কথা জানান। সব কথা জানার পরে লেখকের জন্য মেয়েটি দুঃখ পায় কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, লেখককে তিনি প্রকাশকের জাল থেকে বের করে আনবেন। শুরু হয়ে যায় উপন্যাসের ডিকটেশন। প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একনাগাড়ে আধাঘণ্টা করে ডিকটেশন, আধাঘণ্টা কাজের পরে একটু বিশ্রাম, গল্প, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা। বিকাল চারটেতে বিদায় নিত মেয়েটি। লেখক মেয়েটির হাতে প্রত্যেকদিন তুলে দিতেন লাইন টানা একতাড়া কাগজ। সারাদিন লেখক যতখানি ডিকটেশন দিতেন, রাতে বাড়িতে ফিরে মেয়েটি সেগুলিকে পাণ্ডুলিপিতে পরিণত করতেন পুনর্লিখনের মাধ্যমে। পরের দিন তুলে দিতেন লেখকের হাতে। লেখক কোনো পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করলে পরের দিনে আবার ফ্রেশ কপি করে এনে দিতেন।

এভাবে ছাব্বিশ দিনের মাথায় আনার নেওয়া শর্টহ্যান্ডের সাহায্যে দস্তয়ভস্কি লিখে ফেললেন কালজয়ী উপন্যাস ‘দ্য গ্যাম্বলার’। হ্যাঁ ফিওদর দস্তয়ভস্কি, ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’, ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাযোভ’, ‘দ্য ইডিয়ট’, ‘দ্য অ্যাডোলসেন্ট’ ‘হিউমিলিয়েটেড অ্যান্ড ইনসাল্টেড’ এর মতো সুচিন্তিত ও কালজয়ী রচনার লেখক তিনি। সাহিত্যে আধুনিকতাবাদ, অস্তিত্ববাদ, মনস্তত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি দর্শনে তাঁর অবদান রয়েছে। সাহিত্যের এই উপাদানগুলি তাঁর চিন্তাধারায় আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। আদতে সারা জীবন তিনি মানুষ নিয়েই চর্চা করেছেন। নানাভাবে, নানা দিক দিয়ে তিনি মানুষকে পাঠ করেছেন। তাঁর লেখায় মানুষের তমসাচ্ছন্ন দিক যেমন আছে, আবার সকালবেলাও আছে। তাই নিজেই বলেন, “পুরো মানবজাতিকে আমি যত বেশি ভালোবাসি, ব্যক্তি মানুষকে আমি ততই কম ভালোবাসি।” সর্বোপরি মানুষের চিরন্তন সম্ভাবনায় তিনি বিশ্বাস রাখতেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই যেমন শেষ হল চুক্তি করা উপন্যাস আর সূচনা হল এক আশ্চর্য সম্পর্কের, সমর্পণের … আজীবন ভালোবাসার পিছনে পাগলের মতো ছুটে চলা অস্থির অশান্ত মানুষটিকে শান্ত সুন্দর জীবন উপহার দিলেন এই প্রতিভাময়ী অসম সাহসী নারী। নিজেকে প্রায় বিলিয়েই দিয়েছিলেন দস্তয়েভস্কির প্রবল ব্যক্তিত্ব আর সর্বগ্রাসী জীবন তৃষ্ণার কাছে।

তাঁর উপন্যাস মানে নিজের নানা অভিজ্ঞতা, যন্ত্রণা, জীবনকে যেভাবে যাচাই করেছেন প্রতি মুহূর্তে তাই হয়ে উঠেছে জীবন দর্শন। সতত জীবন সত্যের সন্ধানে ব্যাপৃত দস্তয়েভস্কি নেতি ও ইতির সংশয়ে ক্রমাগত পুড়েছেন।তাই বন্ধু মাইকফকে লিখেছিলেন, “যে মূল প্রশ্নটি আমাকে সারাজীবন নিদ্রায় জাগরণে অনুক্ষণ দগ্ধ করেছে সে হল, ঈশ্বর আছে কি নেই …”। শয়তান’ উপন্যাসে কিরিলফ বলছে, “ যদি ঈশ্বর বলে কেউ না থাকে তো আমিই ঈশ্বর”।

তাহলে তাঁর উপন্যাস? সাদা ,কালো থেকে অনেকটা দূরে এক ধূসর জায়গাতেই যে মানুষের অবস্থান তা বারবার প্রমাণ করে দস্তয়েভস্কির উপন্যাস। এই মেরুকরণের দুনিয়ায় জন্মের দু'শো বছর পরেও আরো বেশি করে প্রাসঙ্গিক তিনি। নীতি -দুর্নীতি ,পাপ, পূণ্যের নতুন ভাষ্য রচনার আগে নিজের দিকে তাকাতে শেখালেন পাপে ও পূণ্যে সমানভাবে নিমজ্জিত সেই জাদুকর। বিস্ময় বিমূঢ় এই পৃথিবীকে অনায়াসে 'নির্বোধ' বলতে তিনিই পারেন একমাত্র। নিত্য জায়মান ও অপসৃয়মান এই বিশ্বে শেষ কথা যে কেউ বলতে পারে না তা বলে গেলেন এই 'প্রফেট'...বিশ্ব-সাহিত্য ও জীবনের দিকদর্শনের একছত্র সম্রাট ও 'ঈশ্বর'।
Share.

1 Comment

  1. দস্তয়ভস্কির কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা ছিল না। মানুষের জীবনযাত্রার দুর্দশা কী করে কাটবে সেটাই ছিল তার আলোচ্য। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদও তিনি সমর্থন করেননি। কারণ ধ্বংসই ছিল তাদের লক্ষ্য, ভবিষ্যতের রাষ্ট্রব্যবস্থা কীরূপ হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা তাদের ছিল না। ঐ মতবাদের সমর্থকরা মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বুদ্ধিকে কোনো আমল দেয় না। কিন্তু দস্তয়ভস্কির মতে, মানুষ কেবল ক্ষুধা মেটাবার যন্ত্র নয়।

Leave A Reply

Exit mobile version