নুন ঝাল মেখে / মিষ্টি রসে কষে/ রোদ্দুরে সেঁকে/… মুখে দিলেম যেই / মজে হারাই খেই… চেখে দেখতে না দেখতে শেষ।মেয়ে তুই পেলি না; ও বউ তুইও পেলি না।

সে এক খাবার বটে। রসালো; চটপটি; টক ঝাল মিষ্টি মিষ্টি। “আ আ আ আ চার… “ সুর করে ওই আচারওলাটা এপাড়া ওপাড়ায় হাঁক দিয়ে বিক্কিরি করে। গলায় মোটা বেল্টের মতো কি যেন ঝুলিয়ে তাতে বেঁধে রাখে একটা ট্রে। তাতে থরে থরে সাজানো প্লাস্টিকের কৌটোয় নানান স্বাদের আচার। এবাড়ি ওবাড়ি থেকে মুখগুলো উঁকি মারে আর ডাকে ওই আচার ওলাটাকে। তেঁতুলের আচার কত করে? কিংবা কুলেরটা একটু মিষ্টি হবে তো? লঙ্কার আচার আছে; লঙ্কার? ঝাল ঝাল বেশ? বরং কাঁচা আমেরটাই আজ দাও। আচারওলাটাকে দেখেই চোয়াল ধরে যায়; জিভ দিয়ে জল পড়ে। আচারওলা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ফরমাশ মতো আচার কৌটো থেকে চামচে চেঁচে সেই কাগজের ঠোঙ্গা হাতে তুলে দেয়। তার আগে ফুটো করা কৌটো ঝেড়ে তাতে ছড়িয়ে দেয় আরো সুস্বাদু করে দেওয়া কি সব মশলা; বিটনুন। আচার না অমৃত! আঙুল দিয়ে এক ছটাক জিভে ঠেকাতেই চোখ বুজে আসে; আবার আচারে ঠেকে আঙ্গুল তারপরে সে আঙ্গুল ঠেকে জিভে। আহা! বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন মাথার ওপর ঘূর্ণি পাক খায়! তারিয়ে তারিয়ে খাওয়ার এ হেন উপকরণ মগজ অবধি চারিয়ে দেয় চরাং করে! এ দৃশ্য হামেশাই আগে দেখা যেত। এখন স্বাদ বদলেছে যদিও তবু সেই ছোটবেলার ইস্কুলের সামনে ভাঁজ করা চৌপায়ার ওপর তক্তা পেতে সেই যে নানা রকম হজমি; আচার আর কারেন্ট নুন বিক্কিরি করতো একটা লোক; মাত্র পাঁচ পয়সা; দশ পয়সা হলেই ঠোঙ্গা ভরে টোকো টোকো লাল কূল একটু বিটনুন ছড়িয়ে টপাটপ মুখে পুরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির ফিরতি পথে যাওয়া। অনেক সময় দেখেছি ভ্যান গাড়িতে কত রকম কৌটো আর তাতে আচারের ছড়াছড়ি। হাতে মাইক নিয়ে জোর প্রচার।ভ্যান গাড়ি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লোকজন কিনছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের আচার। একদিন আবার দেখি টিভিতে রান্না শেখাচ্ছে মুরগি আচারিয়া। নোট বই হাতে খসখস করে লিখে ফেললুম। রেঁধেও ফেল্লুম সুযোগ বুঝে। আহা সে এক অনির্বচনীয় স্বাদ। মুরগি আর আচারের যুগলবন্দী। সবাই বললো আহা আহা তোফা হয়েছে। তবু শেষ পাতে যদি একটু টাকনা জুটতো…

পুরোনো কলকাতার ছাদে কাঁচের বয়ামের মুখে পরিষ্কার ন্যাকড়া বেঁধে সারা শীতকাল আচার শুকোতে দিত মা; ঠাকুমারা। সোলারে রান্না হচ্ছে। যত দিন যাবে আচার মজে একসা। স্বাদ তখন তিনগুণ ছ’গুণ। হয়তো অলিখিত পাহারায় থাকতো বাড়ির ছোট্ট ছেলেটা। বাঘের ঘরেই তো ঘোঘের বাসা। একটু একটু করে চেটেপুটে বয়ামে আদ্দেক হয়ে পড়ে রইলো আচার;  মোরব্বা। মায়েদের সেকি কপাল চাপড়ে হায় হায়। আর ওই ছেলেটার খেলুড়েরাও ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে এসে আড় নয়নে দেখে গেলো থরে থরে বয়ামের আলপনা। সারা পাড়ায় খবর চাউর হয়ে গেলো। দুজন থেকে পাঁচজন; পাঁচজন থেকে একটা ফুটবল টিম ছাদে খেলতে এলো এক বিকেলে। তখন আর বিশল্যকরণী নয়; গন্ধমাদন হাতে তুলে দৌড়। ভাগাভাগি হবে অন্য বাড়ির ছাদের কোণে। আচারের যারা মালকিন তারা পরোয়ানা লিখন পাঠায়ে দিলো এবার থেকে ছাদে খেলা বন্ধ। মেয়েদের আচারের স্বাদে একচেটিয়া আধিপত্য। এ আমি বহুদিন লক্ষ্য করেছি। ছেলেগুলো হাতে গোনা গুটিকয় বাদে সে রসে বঞ্চিত। ছোট মেয়ে থেকে যুবতী মায় বুড়িহাবরি কেউ আচার পেলে ছাড়ে না। সেই যে লাল বেনারসি পরে মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি ঢুকলো দুধেআলতা মাড়িয়ে লাল ছাপ ছাপ ফেলে; সে অফিস যেত না। শাশুড়ির হাততোলায় শুরু হতো তার প্রশিক্ষণ পর্ব। ক্রমশঃ সে বাড়ির গিন্নিমা হয়ে যেত ।বৌমা বৌদিদি থেকে ধীরে ধীরে কাকিমা জেঠিমাদের সমগোত্রীয়। পটের বিবিটি হয়েও আচারের লোভ কি আর সংবরণ করা যায়? শীতের দুপুরে রোদ পোয়ানোর নামে সেই ছাদ। সেই ন্যাকড়া বাঁধা সারি সারি আচারের বয়ামের হাতছানি। তারওপর সে যদি হয় পোয়াতি;  তাহলে তো কথাই নেই। এক অমোঘ টান তাকে টেনে নিয়ে যেত ছাদের সেই কোণে। ভাত ঘুম মাথায় উঠলো। ভেজা এলো চুলে পা ছড়িয়ে বসে উল কাঁটা কিংবা খুঞ্চিপোষ পাশে গুটিয়ে চার আঙ্গুলে এক খাবলা তুলে সোজা মুখে আর চোখ বুজে টকাস টকাস শব্দ। জিভ আর টাগ্রার ঠোক্করে সে যেন এক টঙ্কারের মূর্চ্ছনা।

আজ সে রামও নেই আর সে অযোধ্যাও নেই। আচারের জায়গা নিয়েছে নানান স্বাদের সস্। যুগ পাল্টায়; বেশভূষা পাল্টায়; স্বাদ পাল্টায়। চক্রবত ঘোরে জীবন যখন স্বাদের চাকাও যে ঘুরবে তাতে আর সন্দেহ কি!

তবু গুটিকয় থেকে যায় আচারে নাচার হয়ে।

Share.

1 Comment

  1. anurupa mahajan on

    খুব সুন্দর লিখেছিস, কেন যে নিয়মিত লিখিস না, এরকম আরও কয়েকটা লেখ তাহলে পরের বইটা হয়ে যায়।

Leave A Reply

Exit mobile version