যেন এক অন্য গ্রহের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। এখানে জীবন বল্গাহীন। যাপন অন্তহীন। শহরের বুক চিরে রূপসী নদীময় স্বপ্ন ভরা পাল তোলা নৌকার সারি। প্রাচুর্য আর বৈভবের ভারে ব্যাথারাও যেন এখানে ম্রিয়মাণ! গ্লাসের মধ্যে লাফিয়ে নামা বিষাদও চাপা পড়ে যায় উল্লাসের আতিশয্যে। তবু কানে বেজে ওঠে যৌবনের কাঁপা কাঁপা ঠোঁট বেয়ে আপ্লুত হয়ে গলে পড়া সেই মর্মভেদী শব্দগুলো … “অতল তোমার সাক্ষাত পেয়ে চিনতে পারিনি বলে, হৃদি ভেসে গেলো অলকানন্দা জলে”। 

এখানে হয়তো অলকানন্দা অন্তর্লিনা। এখানে এলোকেশী অপরূপা তার রূপের বাহার বিচ্ছুরিত করে ছুটে চলেছে অতলান্তিক সাগরের অমোঘ ইশারায়। বিগলিত নদীর কূল বেয়ে বিয়ারের উদগ্রীব ফেনা রাঙিয়ে রেখেছে অগনিত কপোত-কপোতীর হৃদয়ের বল্গাহীন উল্লাস। আর সেই রঙের প্রতিটি কণা বেয়ে ঝরে পড়ছে প্রথম বিশ্বের আভিজাত্যের উদ্দাম জৌলুস। ঔপনিবেশিকতার সকল ঔরস ছিনিয়ে এনে গড়ে তোলা সেই কবেকার মায়া ঘেরা শহর আজও যেন ছলকিয়া যৌবনের পদ্ম পাতায় টলোমলো।

এই ঝকঝকে নীল সমুদ্র আর ঝলমলে রোদ্দুরের বাহুতে ডানা মেলে জীবনের উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে স্বদেশের ধূসর বেলাভূমিতেই। কুয়াশার মতো ছেয়ে ফেলে তারা। স্মৃতি কাতরতায় ভরা জল-রঙা কাঁচফুলগুলো। মনে পড়ে যায় সব …… মেঘলা আঁচল, স্মৃতির কাজল। ছুঁয়ে ফেলা গাল, স্বপ্ন অবাধ। ফেলে আসা ক্ষণ, ঝুলে পড়া ঠোঁট। ছেড়ে যাওয়া হাত, বৃষ্টি হঠাৎ…। বন পাহাড়ির সর্পিল বাঁকে এসে আটকে পড়ে ক্ষুধিত যৌবন। ঘন জঙ্গলের আবডালে হাতে হাত রেখে অন্তহীন পথ হেঁটে চলার শপথ। বন পাহাড়ের টসটসে গাল কেঁপে ওঠে উচ্ছ্বাসের আবেদনে। ঝরঝর বৃষ্টি এসে প্লাবন আনে আবেগের আদিগন্তে। পাতায় পাতায় উছলে ওঠা সোহাগের আলিঙ্গন। বৃষ্টিতে ঝুপ্পুস ভেজে বাসনার ত্রিনয়ন।

সামনে অনবরত দুলছে অতলান্তিক ঢেউয়ের আজন্মের উন্মাদনা, আর শনশন করে বয়ে চলা উদ্ভ্রান্ত বাতাসের কাঁপা কাঁপা জলছবি। অসীম সাগরের নীলরঙা শাড়ির আঁচল লোনা হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উড়ছে আদিগন্ত জুড়ে। দূরে জাহাজের বাঁশিতে চলকে পড়ছে এই আনন্দ নগরীর বারোমাস্যা উপাখ্যান। উদাসী সূর্যের ঠোঁট বেয়ে তখনও চলকে পরছে লোনা স্বাদের শিহরণ।

সমগ্র সমুদ্র সৈকত জুড়ে রংবেরঙের বিকিনির আগুনে লক লক করে জ্বলছে উদ্ধত যৌবনের উদ্দাম লেলিহান শিখা। আর তাতে পুড়ে খাক যাচ্ছে সব… আমার চেনা পৃথিবীর সমাজজীবনের রক্ষণশীল শৃঙ্খল, তিল তিল করে গড়ে ওঠা সংস্কারের লক্ষ্মণরেখা। ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, রক্ষণশীলতায় অছিলায় মুড়ে রাখা সকল সুযোগসন্ধানী বর্ম। এই নীলরঙা সমুদ্রে শরীর ভিজেছে কতো শত যুবা, তন্বীর। নোনা আবেগের আস্বাদে ভিজেছে মনও। পর্দানশীন মেঘলা শরীর যেন সামাজিক পর্দার জাল ছিঁড়ে খান খান করে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে মুষল বৃষ্টিধারার বল্গাহিন উল্লাসে।

এখানে সবকিছু সেজে আছে কনে দেখা মেঘের কপাল জুড়ে এঁকে দেওয়া সুবাসিত চন্দনের সাজে। পরিপাটি দিনযাপন। অন্তহীন জীবনযাপন। কিন্তু কোথায় সেই ফেলে আসা ধোঁয়া ধোঁয়া প্রান্তর জুড়ে আলিঙ্গনের আকুতি! কোথায় সেই আদিগন্ত আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ভ্রূকুটি! কোথায় বা সেই কিশলয়ের ঝাঁকে এসে আকাশ ভাঙার নিয়তি! মনের জানালা দিয়ে হুহু করে ঢুকে পড়া মন কেমনের বাতাসে ভিজে যায় সকল তনু-মন-প্রাণ। বুকের মধ্যেকার আদিগন্ত বিস্তৃত ধূধূ প্রান্তর ক্রমশ ডুবে যেতে থাকে নিদারুন স্মৃতি কাতরতার ফল্গুধারায়।

তবুও কি সুদূরের প্রাচীর ভেঙে কোথাও মিলেমিশে নেই আমরা সবাই! এক হয়ে… অন্তরে… কোনও আকুতির তীব্র অনুরননে! কোনও কালান্তরি অপেক্ষার ভারে ক্লিষ্ট হয়ে! হৃদয় জুড়ে অনর্গল রক্তক্ষরণের নিদারুণ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে! হয়তো আছে। থাকলেও হয়তো বা তা সংগোপনে আগলে রাখা আছে অনর্গল তোলপাড় করা বুকের বাঁদিকের লাল টকটকে যন্ত্রটার আবডালে।
Share.

*লেখক অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজ

Leave A Reply

Exit mobile version