গোটা দেশে তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার। দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকেই দিবারাত্র ভেসে উঠছিলো ইংরেজ ভারত ছাড় আওয়াজ। তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে সচেতন ভারতবাসীর মধ্যে। যার প্রভাব থেকে স্কুল পড়ুয়ারাও থেকে বাদ পড়েন না।
এলাকায় এক সাহেবের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। বিপ্লবীদের কাজে অসুবিধা হচ্ছে আরও বেশি। তাই সাহেবকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে চায় তারা। সেই সুযোগও একদিন এসে গেল। এলাকার একটি সভায় হাজির থাকবেন সাহেব। আর সাহেবকে গুলি করে মারার দায়িত্ব পড়ল ওই ছেলেটির ওপর। পকেটে পিস্তল নিয়ে সভার মাঝখানে দাড়িয়ে আছে ছেলেটি। ভয়ে উত্তেজনায় ছেলেটি ঘামছে। এমন সময় সাহেব মঞ্চে উঠছেন। আশপাশে দাড়িয়ে থাকা বিপ্লবী দলের তরুণরা তাকে ইশারা করে। ছেলেটি কাঁপা কাঁপা হাতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে পিস্তল বার করতে যাবে ঠিক তখনই সভা মঞ্চের মাইক থেকে ঘোষণা করা হল, ‘শিবরাম চক্রবর্তী মঞ্চে উঠে এস, উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে হবে’।
ভেস্তে গেল বিপ্লবীদের পরিকল্পনা। সাহেবকে বন্দুক তাক করে গুলি চালানোর বদলে শিবরামকে মঞ্চে উঠে উদ্বোধনী গান গাইতে হল। কিন্তু মনে মনে সে দেশের কাজ করার সংকল্প নিয়েছে। তাকে তো সে কাজ করতেই হবে। তা না হলে এ জীবন বৃথা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ চাঁচোলে এসেছেন। সভায় বক্তৃতা করছেন। গোটা এলাকার মানুষ সেই সভায় হাজির। কিশোর শিবরাম দেশবন্ধুর ভাষণ শুনে এমন উদ্বুদ্ধ হলেন যে দেশবন্ধুর ফেরার ট্রেনের ওই বগিতেই লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন। সোজা দেশবন্ধুর সামনে গিয়ে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে কলকাতায় যাব।’ দেশবন্ধু জানতে চাইলেন, ‘কী করবে কলকাতা গিয়ে?’ শিবরামের সাফ জবাব, ‘স্বদেশী করব।’
কলকাতায় এক মেসে ব্যবস্থা করে দিলেন দেশবন্ধু। মেস-ম্যানেজারের হাতে দশটা টাকা দিয়ে বললেন, শিবরামের বই খাতা পেন জামা সব কিনে দিতে। কিন্তু কীভাবে যেন সেই টাকা শিবরামের হাতে পৌঁছাল, আর দু’দিনের মধ্যে সিনেমা দেখে আর চপ কাটলেট খেয়ে পুরো টাকা শেষ। ম্যানেজারের জেরায় শিবরাম সত্যি কথাই বললেন। কিন্তু তাকে মেসে রাখা গেল না। শুরু হয়ে গেল শিবরামের ভবঘুরের জীবন।
শোনা যায় শিবরাম কলকাতায় এসেছিলেন রিনির খোঁজে। যাকে শিবরাম বলেছিলেন, ‘তুই আমার জীবনে একমাত্র মেয়ে, তুই প্রথম তুই শেষ’। শিবরামের প্রথম চুমু খাওয়ার গল্পেও আছে রিনি। কলকাতা থেকে তাঁর বাবার আনা নতুন গুড়ের সন্দেশ হাতে পেয়ে শিবরাম ভাবলেন, রিনিকে ভাগ না দিয়ে কি খাওয়া যায়? তক্ষুনি ছুটলেন রিনির বাড়ি। শিবরামের হাতের মুঠোয় সন্দেশ দেখামাত্র রিনি দুটো সন্দেশই নিয়ে মুখে পুরে দেয়। ‘ওমা, আমি যে একদম খাইনি রে এখনো’। একথা বলতেই সে মুখ থেকে বার করে হাতে নয়, পাখি-মা তার ছানাকে যেমন করে খাওয়ায়, তেমনি করে তার মুখের গ্রাসের খানিকটা শিবরামের মুখের মধ্যে পুরে দেয়। মুখের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে।শিবরামের জীবনে সেই প্রথম এবং শেষ চুমু। সন্দেশের সঙ্গে মেশানো চুমু। প্রথম অমৃত আস্বাদের জন্য শিবরাম রিনির কাছে চিরঋণী ছিলেন।
স্বদেশী আন্দোলনের জেরে বেশ বিপাকে পড়েই ইংরেজ পুলিশ যুককদের সন্দেহ হলেই জেলে পুড়তো। হাজার হাজার ছেলে তখন জেলে। শিবরামেরও খুব শখ জেলে যাওয়ার। কিন্তু অমন ল্যাকপেকে চেহারা দেখে পুলিশ কিছুতেই আর ধরে না। একদিন ধরল ‘বন্দেমাতরম’ বলে ওঠায়। কিন্তু সেই জেলেও ঘটল অবাক কান্ড। শিবরামের সঙ্গে দেখা হল তাঁর গ্রামের কিশোরী প্রেমিকা রিনির। যে শিবরামের আগেই কলকাতায় চলে এসেছিল সেও রয়েছে ওই জেলে। জেলের মধ্যেই আবার প্রেমিকার সঙ্গে পুনর্মিলন। কিন্তু বেশি দিনের সুখ তো শিবরামের কপালে নেই। কয়েক দিন পরেই অন্য জেলে বদলি হয়ে গেল শিবরাম। আবার বিচ্ছেদ।