নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর থেকে প্রায় ২৬কিলোমিটার দূরত্বে কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের মধ্যে অবস্থিত শিবনিবাস। সেখানে প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো গৌরবময় রাজ রাজেশ্বর মন্দির।
শিবনিবাসে সারা বছরই লোক যাতায়াত করে। শিব-ভক্তরা শ্রাবণ মাসে প্রতি সোমবার নবদ্বীপের গঙ্গা থেকে জল নিয়ে হেঁটে শিবনিবাসে এসে শিবের মাথায় জল ঢালে। বিশাল লাইন হয় সারারাত ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোর থেকে জল ঢালে ভক্তরা। সারাদিন ধরে জল ঢালা চলে। একমাস ধরে মেলা চলে। নাগর দোলনা ও বিভিন্ন রকমের দোকান বসে। দূর দূরান্ত থেকে লোক সমাগম হয়।
কথিত যে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নসরত খাঁ নামে এক ডাকাতকে দমন করতে কৃষ্ণগঞ্জের কাছে গভীর বনের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন ও সেখানে রাত্রিবাস করেছিলেন। ডাকাত দমন করার পর পাশে বয়ে যাওয়া চূর্নী নদীতে মুখ ধুচ্ছিলেন, সেই সময় একটি রুই মাছ তার কাছে চলে আসে। তাই দেখে তাঁর এক আত্মীয় বলেন – রাজভোগ্য জিনিস রাজা না চাইতেই রাজার কাছে উপস্থিত হয়েছে । রাজা যদি এখানে বসবাস করেন তবে রাজার ভালোই হবে।
ওই সময়ে বর্গীদের আক্রমন খুব বেড়ে গিয়েছিল। রাজা তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এরকমই একটা নিরাপদ জায়গা রাজা খুঁজছিলেন। তারপর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরকে মারাঠাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সাময়িকভাবে কৃষ্ণনগর থেকে শিবনিবাসে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। বর্গীদের হাত থেকে রক্ষা করতে ইছামতী আর চূর্ণি নদীকে খাল কেটে জুড়লেন।
জনশ্রুতি যে, দেবাদিদেব মহাদেব নদিয়া-রাজ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন। মহাদেবকে সন্তুষ্ট করতে মহারাজা শিবনিবাসে মন্দির স্থাপন করেছিলেন। ভগবান শিবের নামে নামকরণ করা রাজ রাজেশ্বর মন্দিরটি ১৬৭৬ শকাব্দ বা ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে তখনই তিনি নির্মাণ করেন। এই মন্দিরে স্থাপিত শিবলিঙ্গ এশিয়ার বৃহত্তম বলে মনে করা হয়। ভগবান মহাদেবের সম্মানে ১০৮ টি (যদিও ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে) মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। আবার বর্গীরা শিব ভক্ত ছিলেন, সে কারণেও মন্দির করতে পারেন। রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পরে মহারাজা সম্ভবত এই জায়গাটির নাম শিবনিবাস নামকরণ করেন। অনেকে বলেন, এই নামটি তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রের নামে রাখা হয়েছিল।
মন্দিরের চূড়া সমেত উচ্চতা ১২০ ফুট, আটকোনা মন্দির, প্রতিটি কোনায় মিনার ধরনের সরু থাম। মন্দিরের ভিতর কালো শিবলিঙ্গ, উচ্চতা ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি, বেড় ৩৬ ফুট। সিঁড়ি দিয়ে উঠে শিবের মাথায় জল ঢালতে হয়। পূর্ব ভারতে এতো বড় শিবলিঙ্গ আর নেই। মন্দিরের ছাদ ঢালু ও গম্বুজ। মন্দিরে আছে পোড়ামাটি কাজ ও ইসলামিক ও গথিক স্থাপ্যশৈলীর কাজ।
১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে রাজ্ঞীশ্বর মন্দির ও বাঁদিকে রাম-সীতা মন্দির নির্মিত। বর্গাকার মন্দির। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বিতীয় মহিষীর প্রতিষ্ঠিত ‘রাজ্ঞীশ্বর’ শিব সাড়ে ৭ ফুট। পশ্চিমমুখী চার চালা মন্দির। শিখরে ৪টি মিনার। এখানে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির ও রাজপ্রাসাদ নির্মান করেছিলেন তার মধ্যে দুটি শিব মন্দির ও একটি রাম-সীতা মন্দির অবশিষ্ঠ আছে। বাকি সব কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
কৃষ্ণনগর থেকে কৃষ্ণগঞ্জ হয়ে সড়কপথে শোনঘাটা। শোনঘাটা পেরোতেই ডান দিকে নজরে পড়বে যাত্রীছাউনি, নদীর ঘাট থেকেই নজরে পড়ে সুউচ্চ মন্দিরের চুড়ো।মাত্র তিনটি মন্দির টিকে আছে। বাকি সব ধ্বংস, যার চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শিবনিবাসে।
শিবনিবাস যেতে শিয়ালদহ থেকে গেদে লোকালে করে মাচদিয়া নামতে হবে। সময় লাগবে প্রায় ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিট মতো। এরপর সাইকেল ভ্যানে করে চুর্ণী নদীর তীর। বাঁশ এবং কাঠের সেতুর উপর দিয়ে নদী পার হওয়ার পরে মন্দির চত্বরের কাঁচা রাস্তা ধরে পৌঁছাতে হবে শিবনিবাসে।