বাহান্ন- ঊনসত্তর- একাত্তর- শাহবাগ- পথ-নিরাপত্তা প্রতিবাদ- ফের অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ, অগ্নিগর্ভ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তাল চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা, যশোহর, বরিশাল। জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধ চলছে রাস্তায় রাস্তায়। সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে গুলি চালাচ্ছে পুলিশ। নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে চলছে কোটাকে ঘিরে আন্দোলন।
কোটা মানে সরকারি চাকরিতে নির্দিষ্ট কিছু সংরক্ষিত আসন। ভারতে যেমন ‘সংরক্ষণ’ তফশিলি জাতি, তফশিলি উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য, তেমনি বাংলাদেশেও সরকারি চাকরিতে রয়েছে একাধিক ‘কোটা’। ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের কথা ভেবে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার কথা ঘোষণা করেছিল। এই মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষ। দু-মুঠো ভাতের জোগাড়েই তাঁদের দিন গুজরান হত । কিন্তু মাতৃভূমির লড়াইতে তাঁরাই সামনে এগিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকেই চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা ও নারী কোটা চালু হয়। এতে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ মেধা এবং বাকি ৮০ শতাংশ জেলা কোটা রাখা হয়। এই ৮০ শতাংশ জেলা কোটার মধ্য থেকেই ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধা এবং ১০ শতাংশ কোটা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দ হয়।
চার বছর পর ১৯৭৬ সালে প্রথমবার কোটায় পরিবর্তন আনা হয়। যেখানে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো হয় এবং শুধু নারীদের জন্য আলাদা করে কোটার ব্যবস্থা করা হয়। হিসাব দাঁড়ায় মোট কোটার ৪০ শতাংশ মেধা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং বাকি ১০ শতাংশ জেলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৫ সালে কোটা অপরিবর্তিত রাখা হল কিন্তু ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া না গেলে মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য রাখা হয়।
কোটায় বিভিন্ন সময় পরিবর্তন ঘটেছে। ২০০২ সালে বিএনপি চার দলের জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ কোটার বিষয়ে জানায় মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৩০ শতাংশে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকার প্রার্থী থেকে নিয়োগ হবে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এই ব্যবস্থা বাতিল করে। কোটায় পরবর্তী পরিবর্তন আসে ২০১১ সালে। এই সময় মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরও ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সবশেষ ২০১২ সালে এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করে সরকার।
সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে কোটার পরিমাণ বেশি থাকায় কোটা নিয়ে বাংলাদেশে বরাবরই অসন্তোষ ছিল। যে কারণে বেশ কয়েকবার কোটা আন্দোলন হয়। তবে কোটা আন্দোলন প্রথম বিরাট আকার নেয় ২০১৮ সালে। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পুর্নমূল্যায়ন চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ও দুই সাংবাদিক। কিন্তু মার্চ মাসে ওই রিটটি খারিজ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। ফেব্রুয়ারি মাসে ফেসবুকে ‘কোটা সংস্কার চাই’নামে একটি পেইজ খোলা হয় এবং শাহবাগকে কেন্দ্র করে পেইজটি থেকে মানবন্ধনসহ নানা কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়। তারপরই কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এপ্রিল মাসে শাহবাগ থেকে ডাকা আন্দোলনে অংশ নিয়ে সারা দেশেই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। টানা আন্দোলন কর্মসূচির মুখে ১১ই এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে সব ধরনের কোটা বাতিল ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা।
২০২১ সালে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। গত ৫ জুন তাদের পক্ষে রায় আসে, অর্থাৎ আগের মতো কোটা বহাল হবে বলে জানায় আদালত। হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। সেই আবেদন গত ৪ জুলাই শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল করতে নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। ইতিমধ্যে ১ জুলাই থেকে কোটা বাতিলে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা।