পঞ্চম পর্ব
মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ‘কিং অফ কোকেন’ হয়েছিলেন। আমেরিকার ফ্লরিডা থেকে সমুদ্রপথে ছুটে যেত বিভিন্ন আকারের স্পিড বোট। একই সঙ্গে কলম্বিয়ার উত্তর তীর থেকে কোকেনের বস্তা নিয়ে টেক অফ করত এসকোবারের নিজস্ব বিমান। কোকেনের লেনদেন হত মাঝ সমুদ্রে। আমেরিকার সমুদ্রসীমার বাইরে, বিমান থেকে কোকেন ভর্তি বস্তা ফেলা হত সমুদ্রে। হাওয়া ভর্তি টিউব বাঁধা থাকত বস্তাগুলির সঙ্গে । ফলে কোকেন বোঝাই বস্তাগুলি সমুদ্রে ভাসত। সমুদ্রের জল থেকে কোকেনের বস্তাগুলিকে তুলে নিয়ে আমেরিকার ড্রাগ মাফিয়াদের স্পিডবোটগুলি ছুটে চলত আমেরিকার উপকূলের বিভিন্ন দিকে। কখনও এসকোবারের বিমান সরাসরি আমেরিকায় ঢুকে ফ্লরিডার নির্জন এলাকায়, নর্থ অ্যাটলান্টিকের হিমশীতল জলে ফেলে দিয়ে আসত কোকেনের প্যাকেট। মাঝ সমুদ্রে ভাসতে থাকা মাফিয়াদের জাহাজ জল থেকে কোকেনের প্যাকেট তুলে নিয়ে যেত আফ্রিকার বিভিন্ন বন্দরে। আফ্রিকা হয়ে চোরাই কোকেন ছড়িয়ে পড়ত এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
কলম্বিয়া সরকার তখন এসকোবারকে ‘এনকাউন্টার’ করে মারার প্ল্যান করে। কিন্তু সেই খবর এসকোবারের কাছে পৌঁছাতে দেরি হয়না, কলম্বিয়া সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে এসকোবার আত্মগোপন করেন। ইতিমধ্যে এসকোবারের সঙ্গে কলম্বিয়া সরকারের চুক্তি হয় যে এসকোবার নিজের তৈরি জেলখানায় ৫ বছর আটক থাকবেন, যেখানে থাকবে ফুটবল মাঠ, ক্রিকেট পিচ আর বার, নিজের কারারক্ষী নিজেই ঠিক করবেন, আর পুরো জেলখানায় তিনিই একমাত্র আসামী! সরকার তাতেই রাজি হলো ঠিকই কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা গেল সেই জেলখানা আসলে এসকোবারের বিরোধিতা করা লোকদের টর্চার সেল! অতএব কলম্বিয়া সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে এসকোবারকে সাধারণ কারাগারেই বন্দী রাখা হবে। সে খবরও খুব দ্রুত এসকোবারের কাছে পৌঁছে যায়। ধরা পরার ভয়ে এসকোবার পালান এবং গা ঢাকা দিয়ে থাকেন।
এরপর এসকোবারকে ধরার জন্য কলম্বিয়া সরকার প্রায় ২০০০ জনের বিশাল এক ‘সার্চ ব্লক’ টিম গঠন করে। ওই টিমের সবাই ছিল আমেরিকা থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এসকোবারের হদিস পেতে সেই টিম তন্নতন্ন করে খোঁজ শুরু করে। অবশেষে এসকোবারের ৪৪তম জন্মদিনের ঠিক পরের দিন তারা এসকোবারের খোঁজ পায়। সেদিন সকালে এসকোবার ফোন করেছিলেন ছেলে জুয়ানকে। ফোন ট্যাপ করেছিল প্রতিদ্বন্দী মাফিয়া গোষ্ঠী ‘লস পেপেস’-এর মাফিয়ারা। তারা আগেই এসকোবার যে বাড়িটিতে লুকিয়ে ছিলেন সেই সাদা দোতলা বাড়িটিকে চিহ্নিত করেছিল। ‘লস পেপেস’-এর সদস্যদের নিয়ে কলম্বিয়ার কমব্যাট ফোর্স সেই বাড়িতে হানা দেয়। এসকোবার ও তাঁর দেহরক্ষী জানলা দিয়ে বেড়িয়ে কমলা টালি দেওয়া ছাদ দিয়ে পালাবার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তাদের পেছন পেছন উঠতে শুরু করেছিল কলম্বিয়ার কমব্যাট ফোর্স। শুরু হয় গুলির লড়াই, যা প্রায় এক ঘন্টা ধরে চলেছিল। একসময় গোলাগুলির আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। এর মিনিট পাঁচেক পরেই পরপর দুটি গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। টালির ছাদ থেকে নীচে গড়িয়ে পড়েন রক্তাক্ত এসকোবার। বাড়ির ছাদ থেকে পালানোর সময় গুলি লাগে তাঁর মাথায়, পায়ে এবং বুকে। এসকোবারের সঙ্গীসাথিরা অবশ্য জানায়, শেষ গুলিটি এসকোবার নিজেই তাঁর মাথায় করেছিলেন। কারণ তিনি একবার বলেছিলেন, “আমি আমেরিকার কোনো জেলখানায় পচার চেয়ে বরং কলম্বিয়ার মাটিতেই শুয়ে থাকবো।”পরদিন কলম্বিয়ার জাতীয় সংবাদপত্র ‘লা প্রেন্সা’-য় প্রকাশিত হয়, “কলম্বিয়ার নির্দয় মাদকসম্রাট আর নেই।”
এসকোবার কি সত্যিই এনকাউন্টারে মারা গিয়েছিলেন, নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন ‘কিং অফ কোকেন’? এই প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। যেমন সন্ধান পাওয়া যায়নি ইঁদুরে ও পোকায় কাটা হাজার হাজার কোটি ডলার মূল্যের নোটের বান্ডিলগুলির। প্রায় পচিশ হাজার মানুষ হয়ে ছিলো তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, এত মানুষ মনে হয় না আর কোনো অপরাধীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজির হয়েছিল। আসলে তিনি ছিলেন কলম্বিয়ার “রবিনহুড”। সে দেশে খুব কম সাধারণ মানুষ ছিলেন যে এসকোবারের সাহায্য পায়নি। তাঁকে যত মানুষ ঘৃণা করত তার দ্বিগুণ মানুষ সম্মান করত। তিনি যখন নিজের জেলখানা “লা ক্যাথেড্রাল”-এ ছিলেন সেই সময় অর্থাৎ নব্বই দশকে কলম্বিয়া ফুটবল বিশ্বকাপে হট ফেভারিট। কোকেনের পর এসকোবার ফুটবলের পেছনে বেশি সময় দিতেন। তিনি ফুটবল তারকা ফ্রেডি রিঙ্কন, অ্যাসপ্রিয়া, কার্লোস ভালদেরামাদের সঙ্গে জেলখানায় ফুটবল খেলেছিলেন।
শেষ