বাঁকুড়ার সঙ্গে আশৈশব প্রেম ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের । জীবনস্মৃতি পড়লেই পাওয়া যায় সেই সব অমলিন স্মৃতিকথা।তিনি লিখেছেন-“যদুভট্টের গান শুনে ছেলেবেলায় আমার ঘুম ভাঙতো। দাদাদের গান শেখাবার জন্য বাবামশায় যদুভট্টকে ঠাকুর বাড়িতে নিয়ে এনেছিলেন।”শুধু যদুনাথ ভট্টাচার্যই নন জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকে বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতনে বাঁকুড়ার বহু গুণী সন্তান আপন প্রতিভা বলে গৌরবময় জায়গা করে নিয়েছিলেন। মেলবন্ধন ঘটেছিল শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঘরানার।
কবিগুরুর বাঁকুড়ায় আসা নিয়ে শুরু হয়েছিল নানান জটিলতা ও টানাপোড়েন। বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক ও কবি এডোয়ার্ড টমসনের একান্ত বাসনা কবিগুরু একবার অন্তত বাঁকুড়া ঘুরে যান। তখনকার ওয়েশলিয়ান কলেজের নামী অধ্যাপক টমসন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেছেন। তাঁরই ছাত্রের মাধ্যমে এই যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন। ১৯১৬ খ্রি বাঁকুড়া মিশনারি কলেজের ছাত্র মনোরঞ্জন চৌধুরী এই সংযোগ স্থাপন করেছিলেন। গুরুদেব বাংলা ১৩২২ সনের ১১ মাঘের পর এখানে এলে খুবই ভালো হয় বলে বার্তা পাঠালেন মনোরঞ্জন এর মারফত। প্রসঙ্গত বাঁকুড়ার ছেলে মনোরঞ্জন শান্তিনিকেতনের ব্রম্হচর্য বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। রবীন্দ্রসান্নিধ্য লাভ করেছিলেন সেই সূত্রে। ১০ মাঘ কবিগুরু শ্রীমান মনোরঞ্জনকে লিখলেন- “বাঁকুড়ায় যাইব স্থির ছিল, কিন্তু পতিসরে আমি যে পল্লির কাজ ফাঁদিয়াছি, সেখানে কাজের গোলমাল বাধিয়াছে। শিঘ্রই না গেলে মুস্কিলে পড়িতে হইবে।…দেরি যথেষ্ট হইয়াছে,আর করা চলিবে না। এই জন্যই বেনারস, বাঁকুড়া দুই জায়গারই আহ্বান ফিরাইতে হইল।”তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ কাল। তিনিও তাঁর সাধনায় ডুবে গেলেন। গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছেন গ্ৰামোন্নয়ন ও পল্লী পুনর্গঠনের কাজে। পরবর্তী কালে একেবারে জীবন সায়াহ্নে এসে সিদ্ধান্ত নিলেন বাঁকুড়ায় আসার।
নানারকম বাধাবিপত্তি সরিয়ে কর্মব্যাস্ততাময় জীবন থেকে খানিক সময় বাঁচিয়ে অবশেষে বাঁকুড়ায় আসার জন্য মনস্থির করেই ফেললেন তিনি ।
১৯৪০ সালের ১ মার্চ বোলপুর থেকে খানা জংশন হয়ে রানীগঞ্জ এলেন। বল্লভপুর দামোদর ঘাট পেরিয়ে কবিগুরু মোটরগাড়ি চড়ে মেজিয়া থেকে অমরকানন হয়ে এলেন বাঁকুড়ার হিল হাউসে। কবিগুরুর ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে অন্যতম বিশেষ সুহৃদ জেলার ভূমিপুত্র রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সফরসঙ্গী হিসেবে। সে সময় বাঁকুড়ার জেলা শাসক ছিলেন সুধাংশু কুমার হালদার। তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী ঊষারানী হালদার ছিলেন সমাজ সংগঠক ও সারা ভারত মহিলা সংগঠনের বাঁকুড়া জেলা শাখার সভানেত্রী। আরও বড় পরিচয় হল গুরুদেবের বন্ধুর মেয়ে এই ঊষারানী। বিশেষ স্নেহের পাত্রী ছিলেন তিনি। প্রধানত তাঁদেরই উদ্যোগে বাঁকুড়ায় গড়ে উঠেছিল মাতৃসদন ও শিশু মঙ্গল ভবন। সেই ভবনের শুভ উদ্বোধন করবেন গুরুদেব। তাঁর এই চিরস্মরণীয় বাঁকুড়া সফর উপলক্ষ্যে মহাধূমধাম সহকারে নাগরিক সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই পরমকাঙ্খিত অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন বিশ্ববরেণ্য রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ বাঁকুড়ায় এসে তিনটি দিন কাটিয়ে যান জেলার আপামর মানুষের শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়। এখানকার সারস্বত সমাজ ও বিশিষ্ট গুণীজনদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। শহরের বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি। মাতৃসদন এর উদ্বোধন ও বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল স্কুল পরিদর্শন করেন তিনি। তিনি হিল হাউসে অবস্থান কালে অপার মুগ্ধতায় বলেছিলেন-“এই তো একটা জায়গায় এলুম বাঁকুড়ায়। প্রাদেশিক শহর বটে কিন্তু পল্লীগ্ৰামের চেহারা এর। পল্লী গ্ৰামের আকর্ষন রয়েছে এর মধ্যে। সাবেক দিন যদি থাকতো তো এরই আঙিনায় ঘুরে বেড়াতে পারতুম। এদেশের এক নূতন দৃশ্য শুষ্ক নদী বর্ষায় ভরে উঠে অন্য সময় থাকে বালিতে ভরা। রাস্তার দুই ধারে শালের ছায়াময় বন পেরিয়ে এলুম মোটরে পল্লীশ্রীর ভিতর দিয়ে দেখতে পাইনি বিশেষ কিছুই। এমন তরো দেখা এড়িয়ে যাবার উপায় তো আর নেই…।”বাঁকুড়ার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা সম্ভ্রম বোধ ধরা পড়ে তাঁরই বয়ানে- “তোমাদের অভিনন্দনকে আজ আমি গ্ৰহন করি, আপাতত এ জমা থাক্ গচ্ছিত সম্পত্তির মতো, কালের বড়ো অভিনন্দন সভায় এর যাচাই হবে, তখন তোমাদের এই বাঁকুড়াতেই চন্ডীদাসের পাশে কি আসন পাব- এই প্রশ্ন নিয়ে বিদায় গ্ৰহন করি।”
সেদিনের নাগরিক সভায় কবিগুরু বাঁকুড়া বিষয়ক মৃল্যবান অভিভাষণের পর সম্মিলিত অনুরোধে- “বিনুর বয়স তেইশ তখন “(ফাঁকি) কবিতাটি আবেগ মেশানো দৃপ্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করে বাঁকুড়ার মাটিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে গেলেন বৈদিক পুরুষ সূক্তের এক দ্রষ্টা- রবীন্দ্রনাথ।