আমাদের সংবিধান আমাদের বাক্ স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে। তা বলে কি প্রকাশ্যে কাউকে খিস্তি করতে পারি? নিজের ঘরের মধ্যে পারি,বন্ধুদের আড্ডায় পারি, ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনায় পারি তো অবশ্যই এবং করিও। তার মানে খিস্তি ব্যবহারের একটা পরিসর আছে আর সেখানে আমরা খিস্তি করেও থাকি। এক্ষেত্রে লিঙ্গ এবং বয়সের বেড়া খুব একটা কাজ করে না। তাছাড়াও আমরা সিনেমা হলে, নাটকের প্রেক্ষাগৃহে,ঘরে বসে ওয়েব সিরিজ দেখতে দেখতেও খিস্তি শুনি। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতাতেও খিস্তি পাই। সেই সব খিস্তি শুনে পড়ে আমাদের নানা ধরনের অনুভূতি হয়। আমরা কেউ উল্লসিত হই, কেউ রোমাঞ্চিত আবার কেউ বিরক্ত এবং অস্বস্তি বোধ করি।
প্রসঙ্গত,প্রায় সব ভাষারই খিস্তির একটা ভাণ্ডার আছে। সেই ভাণ্ডারের কিছু খিস্তি সরেস, কিছু রোদ্দুর লেবেলের আবার কিছু বৃষ্টি মার্কা। তবে একথা বললে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না যে ওই খিস্তি থেকে সেই ভাষার শক্তি এবং চলিষ্ণুতার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। তবে খিস্তি ব্যবহারের যে একটা পরিসর আছে তাকে আমরা যেমন মান্যতা দি তেমনি এটাও ঠিক যে খিস্তিরও একটা নিজস্ব মানচিত্র আছে। কথাগুলি খুব তাত্ত্বিক মনে হলেও খিস্তি ব্যবহারের স্থান-কাল-পাত্র গুলিয়ে ফেললে ভাষার দৈন্যতা প্রকাশ পায় এবং তা প্রকট ভাবেই। সেই সঙ্গে কাণ্ডজ্ঞান এবং পরিমিতি বোধের অভাবটাও বেআব্রু হয়ে পড়ে। বন্ধুদের আড্ডায় আমরা সাধারণত যে ভাষায় কথা বলি, সেই ভাষাই কি মা-বাবা দাদু ঠাকুমার সঙ্গে ব্যবহার করি? তাঁদের সামনে তো বন্ধুমহলের ভাষা ব্যবহার করতে কণ্ঠরোধ হয়ে যায়।তা কি কেবলমাত্র আমাদের চারিত্রিক দুর্বলতা বা মধ্যবিত্ত শিক্ষা-সংস্কৃতীয় সীমাবদ্ধতা?
খিস্তিও একটা ভাষা। সেই ভাষাকে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। একটি খিস্তির মধ্যে দিয়ে আমরা খুব গভীর একটা কথা ব্যক্ত করি, তীব্র প্রতিবাদ জানাই, একটি ঘটনার নিন্দা করি। কেউ খিস্তি দিয়ে অনেক সময় মনের দুঃখভার প্রকাশ করে, জমে থাকা কান্না বের করে দেয়। এর মানে খিস্তি ব্যবহারকারীর ভাষার দীনতা কিংবা সেই ভাষারও সীমাবদ্ধতা নয়। খিস্তিটা তখন খুব সহজে বুঝিয়ে দেওয়ার ভাষা। অর্থাৎ খিস্তি ভাষা বৈচিত্রের একটি অঙ্গ। মনের ভাব প্রকাশের সেই মুহুর্তে সেই ভাষা বা খিস্তি সহজ সরল এবং স্বতঃস্ফুর্ত। তাকে সংযত বা দবিয়ে বিকল্প ভাষা প্রকাশের চেষ্টা সম্ভব নয়। তবে একথাও ঠিক যে ঘরের ভাষা, বাইরের ভাষা, রকের ভাষা, কলেজ ক্যন্টিনের ভাষা, পোশাকি ভাষা ইত্যাদি … ইত্যাদি… সমস্ত ভাষারই নিজস্ব চৌহদ্দি এবং উপযোগিতা আছে।
তাই কেউ একটা খিস্তি দিলো মানেই তাকে লক্ষ্য করে “ছিঃ ছিঃ” করে ওঠা কিম্বা একটার বদলে দু-চারটে খিস্তি করে উঠলো মানেই সে একটা অমার্জনীয় অপরাধ করেছে এমনটা ভাবা যায়না। আসল কথা হল সে কী বলতে চেয়েছিল। সে কি আচমকাই দু চারটে খিস্তি দিয়ে উঠলো নাকি তার কোনও বক্তব্য ছিল। সেই বিষয়টাই বিবেচনার। কিন্তু কেউ যদি একটি খিস্তি ব্যবহার না করেও প্যান্ট খুলে কোনও ধর্মকে উদ্দেশ্য করে কিম্বা মহিলাদের উপলক্ষ্য করে কোনও কিছু ইঙ্গিত করেন তাহলে কি সেটা চূড়ান্ত খিস্তি বলে গণ্য হবে না? দেশের রাজধানীর বুকে যখন একজন মুসলমান যুবককে রাস্তায় পিটিয়ে মারা হচ্ছিল আর লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যারা তাকে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বলছিল আর আজাদি আজাদি বলে উল্লাস করছিল। তারা কিন্তু একটি খিস্তিও ব্যবহার করেনি কিন্তু সেই মুহুর্তে তাদের উল্লসিত কন্ঠের ‘আজাদি’ শব্দটিকে কি চরম খিস্তি বলে মনে হয় না? অথচ তাদের বিরুদ্ধে একটি এফআইআরও দায়ের হয়নি, পুলিশও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি আর আদালত বা জেলের তো প্রশ্নই ওঠেনা। ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে আমরা দেখেছি, হয়ত আমরা অনেকেই উল্লসিত হয়েছি, উত্তেজিত হয়েছি,ক্রুদ্ধ হয়েছি অথবা অস্বস্তি বোধ করেছি।
আসলে কোনটা খিস্তি সেটাই গুলিয়ে ফেলছি বা দিচ্ছি। সামাজিক মাধ্যমের রমরমা বাজারে কোনটা ভাষা আর কোনটা খিস্তি চেনা-অচেনা চৌকাঠগুলি খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকের দেওয়ালে প্রতিনিয়ত আমাদের যে ভাবনার অনন্ত প্রকাশ তাতে ভাষার গোত্র নির্ধারণ করাটাই খুব দুস্কর হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে শুভ মহালয়া থেকে বিজয়ার প্রণাম যেমন থাকছে তেমনি কবিতা, গল্প, ভ্রমণথেকে বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, বিপ্লবও। সব কিছুই লাগামবিহীন। মাঝে মাঝে মনে হয় একমাত্র সামাজিক মাধ্যমই পারবে অর্ধসত্যে কামাচ্ছন্ন দুনিয়াটাকে বদলে দিতে। তাই রবীন্দ্রনাথের গানের কথা যখন ধর্ষিত হয় তখন আমরা কান পেতে শুনেও ‘বাংলার সব গো’ বলে মরাকান্না জুড়েছিলাম। কেউ কেউ ‘আর নয়, এবার একতা বিহিত চাই’ বলে শিরা ফুলিয়েছিলাম। আজ সেকারণেই বাম পন্থীরা অনির্বাণ রায়কে সমর্থন করে যুক্তি দিচ্ছেন," উনি তো চাকরির পরীক্ষায় দুর্নীতি করেননি! নিজের মত করে প্রতিবাদ করেছেন মাত্র"। তাই নতুন করে ভাবতে হয় চারটে খিস্তি করা নাকি ফ্যাসিস্টদের পায়ে লুটিয়ে পড়া কোনটা অমার্জনীয় অপরাধ।
3 Comments
অনির্বাণ রায় নামে এই অসভ্য ব্যক্তি দিনের পর দিন এই কাজ করছেন এবং পার পেয়ে যাচ্ছেন। কেন এতদিন তাঁর বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে কিছু কদর্য খিস্তি করার পরে ব্যবস্থা নেওয়া হলো, সে প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু পুলিশ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক কাজ করেছে। যে সব ধারাতে তাঁর বিরুদ্ধে কেস দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এই অসভ্য গাঁজা খোর ব্যক্তিকে থামানোর দরকার ছিল, এ কথা নিশ্চয়ই সকল শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মানবেন।
এটা ইংরেজিতে (পারলে হিন্দিতে ) লেখা হলে ভালো হয়।
দুটোই খারাপ !
একটাকে মান্যতা দিয়ে গিয়ে , অন্যটাকে দুয়ো দেওয়া যায় না বলে আমার অভিমত।