কি লেখা ছিল সেই জলে ভেজা অন্তিম পত্রলেখার বাণীনির্ঝরে? কোনো  স্বীকারোক্তি?  ক্ষমাসুন্দরের প্রতি শব্দবন্ধের নির্মাল্য! অনন্তের পথযাত্রীর সে উপচার রয়ে গেল ঘন যামিনীর মাঝে… প্রথমে নিছক একটু অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি, ক্রমশ রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ নীরবতার ফলশ্রুতি- দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রবি-বিরূপতা, সূত্রপাত ১৯০৩ সালে। দ্বিজেন্দ্রলাল  ‘তারাবাই’ নাটকটি লেখেন ১৯০৩ সালে এবং ১৯০৫ এ ‘প্রতাপসিংহ’। রবীন্দ্রনাথ এই দুটি নাটক সম্পর্কে, যে কোনো কারণেই হোক, তাঁর প্রতিক্রিয়া জানালেন না। এই  নৈঃশব্দ্যকে উপেক্ষা অথবা তাচ্ছিল্য ভেবে নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলালের মনের কোণে বিদ্বেষের যে অগ্নিকণা জন্ম নিল, তাকে হাতপাখার বাতাস দিয়ে, অক্সিজেন যোগান দিয়ে দাবানলে পরিণত করলেন দ্বিজেন্দ্র ভক্তমন্ডলী। তাঁরা কতটা দ্বিজেন্দ্র’র প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও তাঁর হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন বলা কঠিন, কিন্তু সাহিত্য জগতে, সামাজিক বৃত্তে  রবীন্দ্রনাথকে অপদস্থ, অপমানিত করার মহান ব্রতটি চরিতার্থ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, সে বিষয়ে সংশয় নেই।

এ ব্যাপারে  সুরেশ সমাজপতি ছিলেন নাটের গুরু। তাঁর  নানা প্রবন্ধে, চিঠিতে  রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করার প্রবণতা দেখা যায়। হেমেন্দ্রলাল রায় বলেছেন – সুরেশ সমাজপতি যে দ্বিজেন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার চেষ্টা করতেন তা তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। এঁদের  প্রধান অভিযোগ ছিল রবীন্দ্রনাথ দুর্বোধ্য ও অশ্লীল। ১৩১০ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’তে যখন ‘গোরা’ প্রকাশিত হচ্ছে, তখন সুরেশ সমাজপতি ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা দিয়ে শুরু করলেন তাঁর রবি বিরোধ। বললেন, দুর্বোধ্য হলেই গভীর হয় না, কেননা, ডোবার জলও পঙ্কিল। কিন্তু অজিত কুমার চক্রবর্তী ১৩১৩ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘কাব্যের প্রকাশ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের উল্লেখ না করেও কাব্যসৃষ্টির অন্তরালে কবির সাধনা কতটা নিবিড়তম হতে পারে তা সুন্দরভাবে বর্ণনা করলেন। এর উত্তরে দ্বিজেন্দ্রলাল লিখলেন ‘কাব্যের অভিব্যক্তি’। এই চাপান-উতর তবু একটা ভদ্রস্থ পর্যায়ে ছিল, কিন্তু তারপর চলল অভব্য আচরণ, একতরফা। দ্বিজেন্দ্রলালের মতো গুণী সাহিত্যিক, কবি, সুরকার, গায়ক ‘সোনার তরী’-র যে প্যারডি করলেন, তা অত্যন্ত অশোভন, আপত্তিকর। তাঁর নির্দেশে স্টার রঙ্গমঞ্চে জনৈক দেবকুমার রায়চৌধুরী  কদর্য অঙ্গভঙ্গি করে রবীন্দ্রনাথের অশালীন অনুকরণ করে জনসমক্ষে ‘সোনার তরী’ আবৃত্তি করলেন। প্রচুর তথাকথিত বিদ্বান মানুষ সে বদ রসিকতা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন, প্রতিবাদ এবং আসর ত্যাগ করলেন একমাত্র গিরিশচন্দ্র ঘোষ, তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে।

১৯০৫ সালের মে মাসে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘ রবীন্দ্রজীবনী’র দ্বিতীয় খন্ডে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হয়েছে, সেটি পড়লে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দ্বিজেন্দ্রলালের মূল অভিযোগগুলি কী কী। আশ্চর্যের কথা, রবীন্দ্রনাথ সেই চরমপত্রকে গ্রহণ করলেন বজ্রাহত বৃক্ষের মতো শান্ত হৃদয়ে, উত্তর দিলেন সংযমে, পেলব বয়ানে, শালীন অক্ষর বিন্যাসে। এই চিঠি দ্বিজেন্দ্রকে বিহ্বল করে তুললো, এতদিনের মিত্র রবীন্দ্রনাথের প্রতি কয়েক বছর ধরে একপাক্ষিক কালিমালেপন করে গেছেন তিনি! চোরা অপরাধবোধ তাঁকে মনে করিয়ে দিল অনেক অনেক সৌহার্দ্যের স্মৃতি! ভাঙা সম্পর্ক আবার জোড়া লাগলো, রবীন্দ্র-দ্বিজেন্দ্রের দ্বৈরথ শেষ হলো, তবে জোড়া দিলেও ফাটলের দাগটুকু বোধহয় মোছা যায়না। দ্বৈরথের মধুর সমাপন ঈশ্বরের  অভিপ্রেত ছিল না। নইলে অকালে এমন বিয়োগান্ত অধ্যায় সূচিত হলো কেন! ১৭ই মে, ১৯১৩, বাংলা ১৩২০ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল চিরবিদায় নিলেন। মৃত্যুর ঠিক আগে লিখলেন শেষ চিঠি, চিরন্তন বন্ধু, প্রায় সমবয়সী রবীন্দ্রনাথকে। সে চিঠি শেষ হলো না, লিখতে লিখতে ঢলে পড়লেন চিঠি’র ওপর, অজ্ঞান হয়ে গেলেন। জ্ঞান ফেরানোর আকুল চেষ্টায় তাঁর মাথায় অবিরাম জল ঢালা হলো, সেই জলে ঝাপসা হয়ে গেলো চিঠির বয়ান- জ্ঞান ফিরল না। গোধূলির আলোয় অস্পষ্ট অক্ষরমালায় চিঠিতে শুধু স্পষ্ট হয়ে থাকল সম্বোধনটুকু- ‘রবীন্দ্রনাথ’।  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version