কাজের বাইরে এলোমেলো কথা। চিমটি কেটে খুনসুটি। আলতো করে বড় ভুল ধরা বা পিঠ চাপড়ে তিরস্কার। বিপ্রতীপ ভালোবাসাগুলিই যে কোনও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশকে সতেজ রাখে বলে আমার ব‌্যক্তিগত মতামত। কথাচ্ছলে সেদিন এক সহকর্মী আমাকে একেবারে আয়নার সামনে নগ্ন করে দাঁড় করে দিলে। অপ্রাসঙ্গিক এক প্রসঙ্গে সেই সহকর্মী বললেন, ‘অন‌্যকে বদলাতে না পারলে নিজে বদলে যাওয়াই বাঁচার উপায়’। ছ‌্যাৎ করে উঠলাম কথাটা শুনে। সহকর্মীটি কী করে আমার মন এভাবে পড়ে নিল? তাহলে কী আমি উন্মুক্ত হতে হতে একেবারে নাঙ্গা হয়ে যাচ্ছি! সে কী করে বুঝল আমি কিছু ছাড়তে জানি না। হলুদ হয়ে আসা অপেক্ষায় রক্তকরবী ফুটবে, পুরনো পর্দা ভেদ করে বইবে ফিনফিনে হাওয়া বা বৃষ্টি দিনে চড়া রোদের লহরীর আশা ছাড়তে পারিনি তো। হেরে যাওয়া অগুণিত দায় মেনে নিয়ে পাহাড় সমান অভিমান বা গতিজীবনের আড়াল থেকে একলা হওয়ার বৃথা সাহস ধরি কেন আজও জানি না। এক এক সময় নিজেকে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি বোকা বোকা লাগে, আবার এই অনুভূতি এতটাই ভালোলাগে যে অনেকের মতো বুদ্ধিমান হতেও ইচ্ছে করে না। কারও সঙ্গে ঘুরছি, ফিরছি, ভীষণ ভালো লাগছে। প্রতিদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিজেকেই বলে চলেছি, ‘কুছ তো হুয়া হ্যায়, কুছ হো গায়া হ্যায়!’ সকালে ঘুম ভাঙে। নগ্ন হৃদয়ে বাথরুমে যাই। গতকালের ভাবনাগুলিতে হিসু করি। সশব্দে ফ্ল‌্যাশও করে মুছে দিই পেচ্ছাপের হলুদ রঙ। পটি করতে করতে ভাবি, একমাত্র হৃদয়ঘটিত বিষয়েই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা বেঁধেছে। অন্তত সাহিত্য বা সিনেমার জগতে তাই দেখা যায়। নয়তো কি আর দেবদাসের মতো অত নাক উঁচু লোকটার এই পরিণতি হয়?

ইদানিং আমার প্রায়শই মনে হয়, ভাগ্যিস পদার্থবিজ্ঞানে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার সূত্র নিয়ে অত ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন। তা না হলে আমার মতো প্রেমে পোড়া মুখগুলি নিজেদের আড়াল করত কোথায়? শুধু আমার মতো বলে এই সুদূরপ্রসারী সূত্রকে সীমায়িত গণ্ডীর মধ্যে বেঁধে ফেলাটা বোধহয় ঠিক হল না। আইনস্টাইন না থাকলে বোধহয় মানবজীবনের খুব সহজ কিছু বিষয় প্রকাশ করাটা আরও জটিল হয়ে যেত। বিজ্ঞানীর বাকি কথা ধুলায় মিশুক, ‘আপেক্ষিকতা’  শব্দটা তো আমাদের ক্ষত হৃদয়ে বার্নলের প্রলেপ। তাই মোহ, প্রেম বা মনের অলিগলির অন্য অন্য মারপ্যাঁচে ব্যক্তির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর কিছুই নেই। সবই আপেক্ষিক ভাই বলে সটান কেটে পড়াটা আমাদের পক্ষে সহজ হয়ে গিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের সেই উক্তি আউড়ে মনকে শান্ত করতে শিখেছি সেই আপেক্ষিকতাবাদের হাত ধরেই। ‘ভালোবাসাবাসির জন্য অনন্তকালের প্রয়োজন নেই, একটি মুহূর্তই যথেষ্ট’। আসলে আমরা ভালোবাসতে জানি। জানি মানে, বিশ্বাস করি ভালোবাসায়, হিসাবে নয়। আলাদা করতে চাই না প্রেম ও মোহের মধ্যে। কিন্তু মোটামুটি যাঁরা স্টেপ ফেলতে জানেন নিছক মোহ নাকি প্রেম, ভালোলাগার একটা পর্যায়ে গিয়ে এমন প্রশ্ন তাঁদের মাথাতেই আসে। এই নিয়ে অনেক ভেবে মনে হয়েছে, মোহ শব্দটিকে সাধারণত ভ্রান্তির সঙ্গে মেলানো হয়।

একজন ব্যক্তি যখন অপরজন সম্পর্কে আপনমনে একটা ‘ইমেজ’ তৈরি করে নেন এবং সেই ইমেজটিকেই সত্য বলে ধরে নেন, সেই ইমেজ নির্মাণে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন, সেটি হল মোহ। আর সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির প্রকৃত সত্তার সঙ্গে পরিচয় ঘটলে মোহ ভেঙে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ঘটনা। কান্নাকাটি করে লাভ নেই বন্ধু। ভেবে স্টেপ ফেল। পা পিছলে আলুর দম হওয়ার আগে নিজের আবেগকে সংযত করো। অন্যদিকে প্রেমের ক্ষেত্রে শুধু নিখুঁত, নির্ভুল একটি চরিত্রকে উচ্চ আসনে বসিয়ে রাখা নয়, সমানে সমানে চলতে পারা, ঠিক-ভুলে গড়া মানুষটাকে আপন করে নিতে পারার প্রয়োজন আছে। পান থেকে চুন খসলে বিচলিত না হওয়া, দোষারোপ করে সটকে পড়া, অবহেলা করা আসে না প্রেমের ক্ষেত্রে। কারণ, তার কাছে তৈরি করা সত্যটাই প্রকৃত সত্যের চেয়ে বেশি উপভোগ্য। মোহের ক্ষেত্রে বুদ্ধং শরণম গচ্ছামির মতো আত্মনিবেদনের একটা তাগিদ থাকে। সেখানে চলে না কোনও তর্ক বিতর্ক। শুধুই আবিষ্ট হয়ে ল‌্যাজ নেড়ে পিছু পিছু চলা। কিন্তু তার একটা মেয়াদ থাকে। সেই মেয়াদে বুঝিয়ে দেওয়া ‘তুমিই সেরা’। মেয়াদ শেষ হলেই গল্পের নটে গাছটি মুড়িয়ে যায়।

নিছক মুখ ফিরিয়ে নেওয়া থাকে। আবার অপর পীঠে যদি আশার সোনালী বারিবর্ষণের সম্ভাবনা দেখা যায় কদাচিৎ তাহলে বুঝতে হবে সেই মোহ নিজগুণে বদলে গিয়েছে প্রেমে। সে বড় কঠিন বিষয়। আর সেই বিষয়টি একবার মনে বাসা বাঁধলে, ইচ্ছে করবে প্রেমের সব ভুল শুধরে দেওয়ার বিষয়ে জেহাদ ঘোষণা করতে। অনিবার্যভাবে ইচ্ছে করবে ভুল পথ থেকে প্রেমকে সরিয়ে মোহনার উৎসমুখ দেখাতে। তাতে বাজি রাখতে পিছপা হবে না প্রেমকেও, মিস্টি সম্পর্ককেও। মেনে নেওয়া নয়, প্রেমে থাকে মেনে নেওয়া। সেখানে প্রেমের মধ্যে থাকা মোহকে বদলে দিতে না পারলে নিজেকেই বদলে নিতে হয়। কয়েকদিন ধরে মনে ধরেছে শঙ্খবাবুর সেই দু’টি লাইন। ‘হাতের পর হাত রাখা সহজ নয়, সারা জীবন বইতে পারা- সহজ নয়’।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version