দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ, তাঁর ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথের বাল্যবন্ধু ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তখনও তিনি বিবেকানন্দ হননি। দ্বিপেন্দ্রনাথের সূত্রেই নরেন যেতেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। দেবেন্দ্রনাথ পৌত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের এই বাল্যবন্ধুটিকে খুবই পছন্দ করতেন। বিশেষ করে নরেন্দ্রনাথের কন্ঠে গান শুনে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। নরেন্দ্রনাথ প্রায় পাঁচ বছর আহমেদ খান ও বেনি গুপ্তের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা করেছিলেন। তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের পাখোয়াজবাদক কাশী ঘোষালের কাছে পাখোয়াজ এবং বাঁয়া-তবলা বাদনের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা ছাড়াও, উর্দু, সংস্কৃত পারসিয়ান এবং হিন্দি ভাষায়ও গান গাইতে পারতেন। ঠাকুরবাড়ির নানা অনুষ্ঠানে তাঁর ডাক পড়ত। দ্বিপেন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের পঞ্চাশ এবং একান্নতম সাংবাৎসরিক অনুষ্ঠানে নরেন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে নরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত যেমন গেয়েছিলেন পাশাপাশি তিনি দ্বিজেন্দ্রনাথ, গগণেন্দ্রনাথ প্রমুখের লেখা গানও গেয়েছিলেন। এরপর নরেন্দ্রনাথ হিন্দু মেলাতেও রবীন্দ্রনাথের লেখা গান গেয়েছিলেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ভাষায় বিবেকানন্দের মতো ‘এমন উদার বিশ্বতোমুখ গায়ক সচরাচর দেখা যায় না’। বিভিন্ন সময় নরেন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা গান গেয়েছেন। অনুমান করা হয় রবীন্দ্রনাথের ‘দুই হৃদয়ের নদী’ গানটি তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছেই শিখেছিলেন। সময়টা ১৮৮১। রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে লীলাবতীর সঙ্গে কৃষ্ণকুমার মিত্রের বিয়ে। রাজনারায়ণের ছেলে যোগেন্দ্রনাথের অনুরোধে সেই বিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য রবীন্দ্রনাথ তিনটে গান রচনা করে নিয়ে এসেছেন, ‘দুই হৃদয়ের নদী’, ‘জগতের পুরোহিত তুমি’ এবং ‘শুভদিনে এসেছে দোঁহে’। এই বিয়ের অনুষ্ঠানেই নাকি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ। রবীন্দ্রনাথ নিজে নরেন্দ্রনাথকে শেখাচ্ছেন সেই গান আর সুন্দরী মোহনদাস, নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় গলা মেলাচ্ছেন।

বিবেকানন্দকে রবীন্দ্রনাথের লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত যে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, তার প্রমাণ বিবেকানন্দ ও বৈষ্ণবচরণ বসাক সম্পাদিত গ্রন্থ ‘সংগীত কল্পতরু’। বইটি রামকৃষ্ণ মিশনের জন্য অনেকগুলি গানের সংকলন। এখানে অন্যান্য গানের সঙ্গে ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা ১১টি গান। ১৮৮৭ সালের অগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার আর্য পুস্তকালয় থেকে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়।’সংগীত কল্পতরু’ গ্রন্থের ভূমিকায় নরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন,“ব্রাহ্মসমাজ হইতে যে-সকল বাংলা ভাষায় ধ্রুপদ রচিত হইয়াছে, তাহা কি কোনো অংশে হিন্দী ভাষায় রচিত ধ্রুপদ অপেক্ষা মন্দ?” তার মানে তিনি ব্রাহ্মদের সংগীত রচনার প্রশংসাই করেছেন। এবং মূলত তা রবীন্দ্রনাথকেই করা। ১৮৮৫ সালের ১৪ জুলাই বাগবাজারের বলরাম বসুর বাড়িতে তিনি বিবেকানন্দ গেয়েছিলেন ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, ‘গগনের ভালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’, ‘মহা সিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিত’ প্রভৃতি গান।

বিবেকানন্দ তাঁর গুরু অনেকবারই রামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রনাথের  গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের বিভিন্ন ভাগে সেগুলির বিস্তৃত বিবরণ আছে – ১। ‘গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে’ -এই গানটি বিবেকানন্দ দু’বার (২৫ চৈত্র, ১২৮৯ ও ২৭ বৈশাখ, ১২৯২) রামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন।  ২। ‘দিবানিশি করিয়া যতন’-  বিবেকানন্দ (৩০ ভাদ্র, ১২৯১) রামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। ৩। ‘দুখ দূর করিলে দরশন দিয়ে’- এই গানটি বিবেকানন্দ দু’বার (২৯ ফাল্গুন, ১২৯১ ও ৫বৈশাখ, ১২৯৩) রামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। ৪। ‘তোমারেই করিয়াছিজীবনের ধ্রুবতারা’-  বিবেকানন্দ এই গানটিও রামকৃষ্ণকে দু’বার গেয়ে শুনিয়েছিলেন  (৩১ আষাঢ়, ১২৯২ ও ৯ কার্তিক, ১২৯২)। ৫। ‘মহাসিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিত’- এই গান বিবেকানন্দ (৯ কার্তিক, ১২৯২) রামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। ( বিবেকানন্দের জীবনীকার প্রমথনাথ বসু উল্লেখ করেছেন, নরেন্দ্রনাথ বি.এ. পরীক্ষার প্রথম দিন [31 Dec 1883 সোম ১৭ পৌষ ১২৯০] খুব সকালে চোরবাগানে বন্ধু হরিদাস দাশরথীর বাড়ির সামনে গেয়ে শুনিয়েছিলেন।) ৬। ‘এ কি সুন্দর শোভা’- এই গানটিও বিবেকানন্দ (১২ কার্তিক, ১২৯২) রামকৃষ্ণকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। ভারত পরিব্রাজনের সময় কাশিতে (১২৯৫) যজ্ঞেশ্বর তেলী-র বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ এই গানটি এবং ‘মরি লো মরি ও সখী’ ও ‘আমারি দুয়ারে কেন…’ গেয়েছিলেন। ৭। ‘আমরা যে শিশু অতি, অতি ক্ষুদ্র মন’- রামকৃষ্ণের দেহত্যাগের ন-মাস পরে (২৫ বৈশাখ, ১২৯৪) নরেন্দ্রনাথ এই গানটি বরাহনগর মঠ-এ গেয়েছিলেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version