কুড়ি বছর আগে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ইরানের জিরোফত এলাকায় মাটি খুঁড়ে একটি সুন্দর খোদাই করা বোতলের সন্ধান পেয়েছিলেন। তারা দেখেন, সেই বোতলের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন যুগের পুরনো লিপস্টিক। এরপর প্রায় দু’দশক ধরে গবেষণা করে তারা নির্ধারণ করেন, ওই লিপস্টিকের বয়স ৩ হাজার ৭০০ বছর। গবেষকেরা রেডিয়ো কার্বন পদ্ধতিতে বয়স নির্ধারণ করে জানতে পারেন বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো লিপস্টিক এটি। ৩ হাজার ৭০০ বছর পুরনো ওই লিপস্টিকটি ১৬৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি করা হয়েছিল বলে ‘জার্নাল সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’-এ একটি রিপোর্টও প্রকাশিত হয়। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা জানান, ওই লিপস্টিক মূলত হেমাটাইট নামের খনিজ দিয়ে তৈরি। হেমাটাইট নামের অক্সাইড খনিজ ব্যবহার করার কারণে লিপস্টিকটির রঙ লাল।

ইংরেজি Lipstick শব্দের শুদ্ধ বাংলা ওষ্ঠরঞ্জনী, যা এক ধরণের প্রসাধনী দ্রব্য এবং বিভিন্ন রকম রঞ্জক পদার্থ, তেল, মোম এবং ত্বকের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়, এমন পদার্থ থেকে তৈরি হয় এবং মুখের সৌন্দর্য বাড়াতে তা ঠোঁটে ব্যবহার করা হয়। কেবল সৌন্দর্যচর্চা বা ফ্যাশনই নয়, লিপস্টিকের সঙ্গে ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাসেরও গভীর সংযোগ রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে বিভিন্ন বিলাসসামগ্রীর উৎপাদন সাময়িক বন্ধ রাখা হলেও লিপস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করা হয়নি। কেননা, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল মনে করতেন, লিপস্টিক মানুষের মনোবল বাড়ায়। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বজুড়ে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ নারী নিয়মিত লিপস্টিক ব্যবহার করেন। আর ঠোঁটে প্রতিদিন লিপস্টিক ব্যবহার করেন এমন একজন নারী সারা জীবনে প্রায় চার কেজি লিপস্টিক খেয়ে ফেলেন!

১৯৩০ সালে আমেরিকান অভিনেত্রী ইভ আর্ডেন দাবি করেন, ‘যেসব নারীরা লিপস্টিক ব্যবহারে করেন, তাদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি’। দীর্ঘকাল থেকেই লিপস্টিকের ব্যবহার করে আসছেন নারীরা। তবে তখনকার দিনে ফল ও গাছের রস থেকে তৈরি রং ব্যবহার করা হতো সাজসজ্জায়। সুমেরীয় সভ্যতা থেকে মিশরীয় সভ্যতা, এরপর রোমান সভ্যতা- নারী এবং পুরুষ উভয়ই ঠোঁট রাঙাতে ব্যবহার করত বেরি বা জাম জাতীয় ফল, পান পাতা, লাল সীসা, মাটি, মেহেদি, বিভিন্ন পোকামাকড়, গাছ-গাছড়া কিংবা বিভিন্ন খনিজ। তবে সেসব উপাদান ব্যবহার করা হত আঠার সাহায্যে। কারণ যাতে তা ঠোঁটে লেগে থাকে। এরপর উচ্চবিত্ত মেসোপটেমিয়ানরা ঠোঁট রাঙাতে রত্নচূর্ণ ব্যবহার করত। মিশরীয়রা রঞ্জক পদার্থ যেমন অ্যালজিন, আয়োডিন ও ব্রোমিনের মিশ্রণে লাল রঙ তৈরি করে লিপস্টিক ব্যবহার করত। ফারাও রাণী ক্লিওপেট্রা গাঢ় লাল রঙ ব্যবহার করতেন ঠোঁটে।যা তৈরি হত মেরুন রংয়ের বিটল পোকা থেকে, এর ফলে ঠোঁটে একটি গাঢ় লাল আভা ফুটে উঠত।  

আধুনিক লিপস্টিকের বাণিজ্যিক উৎপাদন লিপস্টিক নামের প্রচলন হয়েছে ১৮৮০ সালে। প্রথম বাণিজ্যিক লিপস্টিক উৎপাদনে ফ্রান্সের নাম উঠে আসে। ১৮৮০ সালে প্যারিসে সুগন্ধি শিল্পেই তৈরি হয় বাণিজ্যিক লিপস্টিক। ১৮৯০ সালের শেষদিকে ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে লিপস্টিক বিক্রি করা শুরু হয় এবং এর প্রসারে বিজ্ঞাপন প্রচারও শুরু হয়। সেই সময় লিপস্টিক কাগজের কৌটোয় বা টিউবে বিক্রি করা হত। ১৯১৫ সালে মরিস লেভি প্রথম ধাতব কৌটোর লিপস্টিক তৈরি করলেন যা ঠেলে উপরে তোলা যায়। তারই হাত ধরে আধুনিক লিপস্টিকের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়। লিপস্টিকটি ছিল সহজে বহনযোগ্য এবং সাধারণ নারীদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। যা আমরা আজ ‘আধুনিক লিপস্টিক’ বলে জানি তার নাম ‘সুইভেল-আপ’ লিপস্টিক। এটি সর্বপ্রথম উদ্ভাবন হয় ১৯২৩ সালে। এই লিপস্টিকের উদ্ভাবক জেমস ব্রুস জুনিয়র এটিকে বলেছিলেন ‘টয়লেট আর্টিকেল’। যুগে যুগে লিপস্টিকের সঙ্গে সমাজ বাস্তবতা, অর্থনীতি, রাজনীতি ও ধর্ম জড়িয়ে গেলেও লিপস্টিকের জনপ্রিয়তা কমেনি একটুও।

নানা রঙের লিপস্টিক নানা অর্থ বহন করে। যেমন, লাল রঙ লাল লিপস্টিকের আবেদন কখনোই পুরনো হয় না। ষোড়শ শতাব্দীতে রানী প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন প্রসাধনীর প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট। তিনি সাধারণত ঠোঁটে লাল রঙ ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারের পর লাল লিপস্টিক পরাকে শয়তানের কাজের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করা হত। প্রসাধনী নিষিদ্ধ করার জন্য তৎকালীন পোপ নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে তার ফলশ্রুতিতে লিপস্টিক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু তখন লাল বা গাঢ় রঙের পরিবর্তে জায়গা করে নেয় গোলাপি রঙ।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version