বলা হয়, সময় দ্রুত চলে যায়। কিন্তু পৃথিবীতে এমনও একটি দেশ আছে যেখানে সময় পুরো পৃথিবীর সময়ের থেকে পিছিয়ে। যেন এখানেই সময় থেমে গিয়েছে। সেই দেশটি হল ইথিওপিয়া। অন্যান্য দেশের তুলনায় ৭ বছর পিছিয়ে সেই দেশ। গোটা বিশ্বজুড়ে এখন ২০২৪ সাল। কিন্তু ইথিওপিয়ার ক্যালেন্ডারের পাতায় লেখা ২০১৭ সাল। কিন্তু হিসেব এমন কেন? আসলে ইথিওপিয়ায় যিশুখ্রিষ্টের জন্মসালকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় পশ্চিমা ক্যালেন্ডারের সাত বা আট বছর পর। ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরি ত্রয়োদশ এই ক্যালেন্ডার প্রতিষ্ঠা করেন। বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুসারে, রোমান চার্চ এই ক্যালেন্ডারের গণনা করেছেন এই ভাবেই।পুরো বিশ্বও এটি মেনে নেয়। অন্যদিকে, ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স চার্চ পুরোনো ক্যালেন্ডারের হিসাবে চলার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইথিওপিয়ান ক্যালেন্ডারে ১২ নয়, ১৩ মাস রয়েছে। সেখানকার ক্যালেন্ডার বাকি বিশ্বের থেকে ৭ বছর ৩ মাস পিছিয়ে। এখানে শেষ মাসকে বলা হয় পাইগুম, যা মাত্র ৫ বা ৬ দিনের। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শেষ মাসটিতে কয়েকটি দিন জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যে দিনগুলো কোনো কারণে বছরের গণনায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ইথিওপিয়া এখনও তার প্রাচীন ক্যালেন্ডার ব্যবহার করছে। এখানকার লোকজন তাদের সেই ক্যালেন্ডারের কারণে ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে নতুন শতাব্দী উদযাপন করেছিল। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। ইথিওপিয়া তার নিজস্ব ক্যালেন্ডার সিস্টেম অনুসরণ করে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনগুলো হয় যে দিনগুলো বাকি বিশ্বের থেকে আলাদা।
ইথিওপিয়া কখনোই উপনিবেশ–শাসিত ছিল না। ইথিওপিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে আলেকজান্দ্রিয়ার কপ্টিক অর্থোডক্স চার্চের কপ্টিক ক্যালেন্ডারের অনেক মিল রয়েছে। এটি মিসরে অবস্থিত প্রাচ্যের একটি অর্থোডক্স খ্রিষ্টান চার্চ। সৌর-চন্দ্র পদ্ধতি অনুসারে, ইথিওপিয়ান ক্যালেন্ডারে বছরে ১৩ মাস হয়। এর মধ্যে ১২ মাস ৩০ দিন করে এবং শেষ মাস ৫ দিন (লিপ ইয়ারে ৬ দিন হয়)। ইথিওপিয়ায় আন্তর্জাতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পশ্চিমা ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। আবার দেশটির অসংখ্য মানুষ দুটি ক্যালেন্ডারই মেনে চলেন। বিশেষ করে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় যাঁরা বসবাস করেন। অনেকে দুটি ক্যালেন্ডার মেনে চলাটাও বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত করে নিয়েছেন। তাদের কাছে ইথিওপিয়ান ক্যালেন্ডার বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কারণ, এটি অনুসারে বর্ষাকাল শেষেই নতুন বছর শুরু হয়। একই সময়ে ‘আদে আবাবা’ নামে দেশটিতে স্থানীয় একটি আদিবাসী ফুল ফোটে। এটিকে নতুন বছরের প্রতীক বলে মানা হয়। তারা বলেন, নতুন বছরে সবকিছু যেন নতুনভাবে শুরু হয়। যেটা আমাদের জন্য নতুন সূচনা। ওই সময় বৃষ্টি কমে যাওয়ায় চারদিকে কেবল সবুজ প্রকৃতি চোখে পড়ে।
যে ইথিওপিয়ায় ইংরেজি নববর্ষের শুরুর দিন ১ জানুয়ারি কোনো তাৎপর্য বহন করে না। তখন মরসুম শুষ্ক থাকে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই নতুন দিন শুরু হয় মধ্যরাতে। কিন্তু ইথিওপিয়ায় দিন শুরু হয় সকালে। অন্যান্য দেশের সকাল ৭টা (সেভেন এএম), ইথিওপিয়ায় হয় সকাল ১টা (ওয়ান এএম)। বিদেশি পর্যটকদের সময়ের এই পার্থক্য নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ক্ষেত্রে সব সময় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেন যে তাঁরা ইথিওপিয়ান সময়ের কথা বলছেন নাকি পশ্চিমের। এই দেশে আসা পর্যটকদের কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। মানুষ এখানে প্রথম বসবাস শুরু করেছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। এই দেশটিতেই ৩.২ মিলিয়ন বছরের পুরনো একটি হোমিনিড কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে এখানকার আফার অঞ্চলকে সবচেয়ে প্রাচীন বলা হয়।
ইথিওপিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলির একটি। মাথাপিছু আয় মাত্র প্রায় ১ হাজার ডলার। দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর। কিন্তু অনুর্বর জমি, কয়েক বছর পর পর ভয়াবহ খরার কারণে কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধি দুরূহ। ভুট্টা, আখ, গম, যব ও জোয়ার এখানকার প্রধান খাদ্যশস্য। কিন্তু দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং খাদ্য সাহায্যের উপর বহির্বিশ্বের উপরে নির্ভরশীল। ইথিওপিয়াতে উৎপাদিত কফি ও পশুচর্ম বিদেশে রফতানি হয়। গবাদি পশু, ভেড়া ও ছাগল থেকে মাংস ও চামড়ার চাহিদা পূরণ হয়। শিল্পখাতের আয়তন অত্যন্ত ছোট। এখানে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, চামড়ার দ্রব্য ও রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করা হয়। এছাড়া খনিতে লবণ, সোনা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলন করা হয়।২০১০ সালে দেশটি কেনিয়াকে ছাড়িয়ে পূর্ব আফ্রিকার বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়। এই উন্নতি সত্ত্বেও ইথিওপিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলির একটি।