নিবেদিতা জগদীশ্চন্দ্রের বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম সহায়ক ছিলেন। জগদীশচন্দ্রের লেখালিখির সম্পাদনা, এমনকি বসু বিজ্ঞান মন্দির গড়তেও সাহায্য করেছিলেন তিনি। কীভাবে নিবেদিতা আগ্রহী হয়েছিলেন জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান চর্চায়। এ দেশে এসে নিবেদিতা মানবকল্যাণের কাজে জড়িয়ে ভারতীয় মেয়েদের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য কাজ করতে করতে স্বাধীনতা আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েন। নন্দলাল বসু নিবেদিতাকে একাধিকবার ভারতীয় শিল্পকলার সমঝদার উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় বিজ্ঞানের উন্নতিতেও নিবেদিতার যথেষ্ট অবদান ছিল।

১৮৯৮ সালের কথা। প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন নিবেদিতা। এর মাস দুয়েক আগে তিনি এদেশে পৌঁছেছেন। জগদীশ তখন আধুনিক পদার্থবিদ্যার মৌলিক গবেষণায় ব্যস্ত। আশ্চর্যের বিষয় মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল যিনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেননি অথচ সেই সময়কার বন্দিত একজন বিজ্ঞান গবেষকের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হন তিনি। হয়ত পরাধীন ভারতের বিজ্ঞানী প্রফেসর বোসের বেতার সংকেতের কথা শুনেছেন। তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেন বেতার সংকেত প্রেরক ও গ্রাহক যন্ত্রের স্রষ্টাকে। এত অনাড়ম্বর আর সাদামাটা গবেষণাগার অথচ তার মধ্যেই আধুনিক বিজ্ঞান সাধনায় জগদীশ মগ্ন। তবে তখন তিনি বেতার তরঙ্গ নিয়ে নয়, অন্য অনুসন্ধানে বিভোর। জগদীশ তখন জীবনের মতন জড় পদার্থের মধ্যেও খুঁজে পাচ্ছেন উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার লক্ষণ!

প্রাণহীন জড় পদার্থ এবং উদ্ভিদের মধ্যে জেগে ওঠা অনুভব আর সংবেদনের সুর শুনতে পাচ্ছেন তিনি। বিদেশিনী অতিথিকে সেদিন জগদীশ তাঁর সেই নতুন পর্যবেক্ষণের কথা বলেন। অবাক বিস্ময়ে তিনি তা শোনেন। মুগ্ধ নিবেদিতা জগদীশের পাশে দাঁড়িয়ে গবেষণার কাজে সহায়তা করতে চান। নিবেদিতা সারা বুলকে চিঠি লিখে জগদীশের কথা জানান। সারা বুলের ১৫ হাজার ডলার অর্থ সাহায্যে বেলুড়ে মঠ আর সন্ন্যাসীদের বাসস্থান তৈরি হয়েছিল। মেয়েদের শিক্ষার জন্য নিবেদিতা যে স্কুল করেছেন সেখানেও সারা বুলের সাহায্য ছিল। এরপর জগদীশ দেখলেন যে বিদেশের বহু সংবাদপত্র তাঁর কাজের প্রশংসা করছে এবং বিদেশ থেকে তাঁর কাছে চিঠি আসছে। তখনও জগদীশ জানতেন না যে এর পেছনে আছে নিবেদিতার আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। ইওরোপের কাগজে ফিচার লিখতেন মার্গারেট। সেই সূত্রে বিদেশের বহু সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। সেই যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ইওরোপের সংবাদপত্রে জগদীশের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্পর্কে খবর ছাপতে শুরু করলেন নিবেদিতা।

নিবেদিতার পক্ষে ওই কাজ যেমন কঠিন তেমনই সাহসের। কারণ নিবেদিতা বিজ্ঞানের ছাত্রী নন। আর এসব লেখার ক্ষেত্রে শুধু বিজ্ঞানের ছাত্র হলেই হয় না। কারণ, তিনি যে বিজ্ঞান লেখার দায়িত্ব নিয়েছেন সেটা একজন বিজ্ঞান গবেষকের বিজ্ঞান সাধনার ফল। প্রথমে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের কাছ থেকে শুনে বুঝে নেওয়া, তারপর সেই বিষয় নিয়ে লেখা। এরপরও একটি বিষয় এসে পড়ে তাঁর এই ধরণের কাজের মধ্যে। সেটি হল, নিবেদিতার ভারতে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিবেকানন্দের সঙ্গে থাকা। বিবেকানন্দ তাঁকে এ দেশের নারীশিক্ষার প্রসারের দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নিবেদিতা যে কাযে মনোযোগী হয়েছেন তা জগদীশচন্দ্রর বিজ্ঞান সাধনা। এতে তাঁকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাড়াতে হতে পারে। কিন্তু সেই ভয় নিবেদিতার একটুও নেই। কোথা থেকে তিনি সেই জোর পাচ্ছেন। নিবেদিতা সারা বুলকে জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আর কোনো বন্ধুত্ব থেকে আমি এমন উপলব্ধি পাইনি’। জগদীশ্চন্দ্র নিবেদিতাকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে এমন উঁচুতে স্থান দিয়েছি যেখানে হয়তো এখনো তুমি উঠতে পারোনি, কিন্তু আমার বিশ্বাস একদিন তুমি সেই উচ্চতা ধারণ করবে।”

তবে একদিন নিবেদিতা জগদীশচন্দ্রের কাজ এবং মনের সঙ্গে এভাবে জড়িয়ে যাওয়ার জন্য কিছুটা অপরাধবোধে ভুগেছিলেন। গুরু বিবেকানন্দের অনুমতি না নিয়ে এরকম মানসিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? এই প্রশ্নও নিজেকে করেছিলেন। একদিন গুরু স্বামী বিবেকানন্দকে নিজের মনের সব কথা খুলে বললেন। নিবেদিতা এও বললেন যে তিনি যদি চান তবে জগদীশের কাজ থেকে তিনি নিজেকে পুরোপুরি সরিয়ে নেবেন। কিন্তু বিবেকানন্দ জানতেন নিবেদিতা যে জগদীশকে সাহায্য করছে তাতে ভারতীয় বিজ্ঞানের উন্নতি হচ্ছে এবং তাতে ভারতবাসীকেই পরোক্ষভাবে সাহায্য করা হচ্ছে। তাই বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে বললেন সে মনে কোনরকম অপরাধবোধ না রেখে যেন কাজ চালিয়ে যায়। জগদীশচন্দ্রের বহু গবেষণাধর্মী লেখালেখির সম্পাদনা করেছিলেন নিবেদিতা। শুধু সম্পাদনাই নয়, জগদীশের ওইসব গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ এবং পুস্তক রচনায় প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছিলেন নিবেদিতা। তাঁর সাহায্য ছাড়া জগদীশের পক্ষে বসু বিজ্ঞান মন্দির গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version