নরম রোদ এখন। সূর্যের তেজ নেই;মানুষের মনও নরম। বাসে ট্রামে গায়ে গা কিংবা পায়ে পা দিয়ে ও ঝগড়া নেই।প্রকৃতি মিঠে সঙ্গে মানুষের মনও মিঠে। কতদিন গ্রামে যাইনি। পুরুলিয়া যাওয়াটা নেশা ছিলো। কথা নেই বার্তা নেই চল তবে আদ্রাচক্রধরপুর ধরে ভোরবেলা হালকা ফুরফুরে মেজাজে পুরুলিয়া ষ্টেশনে নামি… কতবার এমন হয়েছে।কুমারীকানন;হারাই নদীর জলে গা ডুবিয়ে অভির বাড়িতে কাঁসার বাসনে ভাত আলুপোস্ত আর কুচি করে কাটা দিশি মুরগির ঝোল। কুমারী কাননের কাছে উত্তমের বাড়ি।মাটির বাড়ি;খড়ের চাল;ধান কাটা সারা হয়ে গাদা করে খড় রাখা এক পাশে। মাঝে উঠোন; গরু বাঁধা।উত্তমের বাবা শক্ত ঋজু; মুখে দাড়ি। কি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সব শক্তি প্রকৃতি থেকে শুষে নেওয়া যেন। কাঁসাই নদীও যে চেনা।সেবার তো এপার ওপার খেলা খেলতে বেলা গেলো।

কতবার গেছি খড়িদুয়ারা গ্রাম;খোলা মাঠে এদিক ওদিক ম্যারাপ বেঁধে লোকগান। আকাশের নীচে সাঁওতাল নাচ;ধামসা মাদল দ্রিম দ্রিম। সারা রাত ধরে মেলা। ওরা লাল পেড়ে শাড়ি পরে নি। জীর্ণ থান;শাড়ি আবার কয়েকটি ছোট্ট মেয়ে ফ্রক পরে। পবিত্র অথচ উদ্দাম উৎসব। চড়িদা গ্রামে গম্ভীর সিং মুরার বাড়ি। ছৌ শিল্পী তখন বিশ্বখ্যাত। মুখোশ পরে আছে ইতি উতি। খাটিয়া পেতে আমাদের অভ্যর্থনা করলো। বেশিরভাগটাই তখন কবি বন্ধু নির্মল হালদারের বদান্যতায় এত সব

আস্বাদন মন প্রাণ ভরে। বলতে গেলে টেনে নিয়ে যেত বারবার ওর গ্রাম;বাড়ি। আমাদের শহুরে মনে ঘোর নেশা। বাঁধ;জলাশয়;শাল পলাশের জঙ্গল। কোনো সাজ নেই;কায়দা নেই শুধু এক পবিত্র প্রকৃতির বুকে এপাশ ওপাশ করে গড়িয়ে যাওয়া। সবুজ লাল রং মনে শরীরে মেখে আজব রং খেলা। নির্মলদা বলতো “ওই পাহাড়টা আমি কিনেছি;তোকে দিয়ে দেবো”।”না” আর বলি করে…এমন ভাবে অনেকগুলো পুরুলিয়ার পাহাড় আমার মুঠোয় এখন;জলের দরে পাওয়া।

ইনল্যান্ড লেটারে লেখা চিঠির ভাঁজে পলাশ মুঠো মুঠো। পলাশের রঙে চিঠির শব্দেরা লালে লাল। শব্দের বাড়বাড়ন্ত। এক এক সময় আবার ওরা শহরে আমার বাড়িতে এলে হাতে করে নিয়ে আসতো ধানের শীষে বাঁধা আলপনা। ঘরে সাজানো আছে এখনো আমার। পরে শুনলুম কোন এক পরবে গরুর কপালে সাজিয়ে গো মাতার পুজো হয় ওই ধানের আলপনা দিয়ে। দেউলঘাটা গ্রামে এদিক ওদিক কতো পাথরের দেবদেবীর মূর্তি। কোনো ইতিহাস থেমে আছে। কোনো মূর্তির গায়ে মাথায় সিঁদুর লেপে দেওয়া; নিশ্চই পুজো পার্বণে ভক্তির নিদর্শন। চুরি হয়ে গেছে আরো কতো যে মূর্তি। মহুয়ার সে স্বাদ আহা!

আমিই তখন অরণ্য;আমিই তখন ঘোর আঁধার গায়ে মেখে দুলির লোভী চোখ। লাল মাটির রাস্তা এঁকেবেঁকে গিয়ে সটান উঠে গেছে অযোধ্যা পাহাড় বেয়ে। ঝর্ণার নাম বামনী। উপচে পড়ছে জল। নিশুতি রাতে বান্দোয়ানের রাস্তার অন্ধকার চিরে হু হু করে গাড়ি ছুটেছে সার্কিট হাউসের দিকে। কাঁচপোকার টিমটিম ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। আকাশের তলায় সবুজ ঘাসে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ার ক্ষণ।” নিখিল তোমার এসেছে ছুটিয়া,   মোর মাঝে আজি পড়েছে টুটিয়া হে …”

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version