তিন

যেন রবীন্দ্রনাথের দেওয়া ছোটগল্পের সংজ্ঞা। শেষ হয়েও হইল না শেষ। বাঙালির উৎসবের রেশ জারি। সেরা উৎসব দুর্গাপুজো শেষ হয়েছে। রাজধানীর সেরা রাস্তা রেড রোড ধরো সপরিবার দেবী দুর্গা কৈলাসে প্রত্যাবর্তন করেছেন। দেবীর মুখে চিড়ে—দই—গুঁজে দিয়ে দুর্দান্ত সিঁদুরখেলা লাইভ সম্প্রচার হয়েছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে। নিয়ম মেনে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সেই সিঁদুরখেলার লাল—লাল মুখ মুখপুস্তিকায় জ্বলজ্বল করেছে। নারীবাদীরা যেন মুক্তির আস্বাদ নতুন করে পেলেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার মধে্যও খুঁজে বেড়িয়েছে স্লিভলেস ব্লাউজে প্রদর্শিত মসৃণ বাহুতল, শাড়ির আঁচল ভেদ করে জেগে ওঠা দম্ভিত—ক্লিভেজ, অংশত উন্মুক্ত কটিদেশে উচ্চারিত দুরন্ত যৌবন।

ভ্রমর প্রশ্ন তুলল, বিয়ের পর পুরুষদের যদি কোনও চিহ্ন ব্যবহার করতে  না হয়, তাহলে মহিলারাই বা সিঁদুর পরেন কেন? মহিলা যে একটি নির্দিষ্ট পুরুষের সম্পত্তি, সে বার্তা বহন করতেই কি এই আইএসআই মার্কা ছাপ? বিবাহিতা—অবিবাহিতাদের পৃথক করতে সিঁদুরের এই গন্ডিকাটা কি সমাজের জবরদস্তি নয়? ধর্ম আর সংস্কারের এই বিতর্ক যতদিন গড়িয়েছে ততই প্রবলতর হয়ে উঠেছে।

এই বিষয় নিয়ে লক্ষ্মীপুজোর রাতে ভ্রমরের সঙ্গে প্রবল ঝগড়া বেধে গেল। সে বলল, সিঁদুরের উপর যতই উষ্মা থাক না কেন, সিঁদুর ভারতীয় নারীদের কাছে অত্যন্ত আদরণীয় বিষয়। সিঁদুর ব্যবহারকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দম্ভ বলে মনে করছো। দম আছে। তবে এ কথা ঠিক যে ভারতে ‘পুরুষতন্ত্র’ আর্যরাই নিয়ে আসে। আর্যরা এসেছিল পশ্চিম থেকে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে ওইদিকে সিঁদুর দিয়ে বৈবাহিক চিহ্ন প্রদানের কোনও প্রথা ছিল না। আবেস্তাকে যদি ঋকবেদের পূর্বসূরি ধরা যায় তবে নিঃসন্দেহে ভারতীয় বৈদিক সভ্যতা যে আবেস্তীয় পারসিক সমাজের ছায়া হবে—তা অনস্বীকার্য। পারসিক বৈবাহিক রীতিতে জরাথ্রুস্টিয়ান বৈবাহিক পদ্ধতিতে সিঁদুর অনুল্লেখিত। অথচ সেই পারসিক সংস্কৃতির ধারকরা ভারতে এসে সিঁদুর খেলায় মাতল। ভ্রমরের কথা থামিয়ে কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পাইনি। ভ্রমর থামতে চায় না। বলে, যদি সিঁদুর শব্দের প্রাতিপদিক অনুসন্ধান করা হয় তাহলে দেখা যাবে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতরাই হোঁচট খাচ্ছেন বারে বারে। বৃক্ষ বিশেষ, রক্তচূর্ণ বিশেষ, বলে স্বয়ং হরিচরণ ক্লান্ত।

সিন্দুর বা সিঁদুর শব্দটা হইচই করে মহাকাবে্য এসে পড়েছে বৈদিক যুগের পরে। এটা আশ্চর্যের। অর্থাৎ পারসিক যাযাবর কৌম সমাজ যারা ভারতে এসেছিল তাদের শব্দভাণ্ডারে সিঁদুর না থাকলেও ভারতের মাটিতে এসে তারা এই শব্দে আকীর্ণ হল। সিঁদুরে রাঙা হল। এটা বোঝা দরকার। ভারতে আর্যদের আসার আগে দ্রাবিড়ীয় জাতিগোষ্ঠী ছাড়াও দু’টি অত্যন্ত সভ্য জাতি বিরাজ করত এখানে। তারা হল তিব্বতি ও অস্ট্রিক। হরপ্পা—মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাপ্ত সিলমোহর ও মূর্তিতে তিব্বতি—বর্মি উপকরণ নেই বললেই চলে। যাবতীয় দ্বন্দ্ব তৈরি হয় অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের নিয়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অস্ট্রিক গোষ্ঠীর বহু জনজাতির বর্তমান বংশধররা আমাদের মতো বলিয়ে কইয়ে নন। কোরকু, ঘারিয়া, হো, সাঁওতাল প্রভৃতিদের মধ্যে সাঁওতালরাই একমাত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এত কথা বলছি একটাই কারণে, হরপ্পায় প্রাপ্ত নারী মূর্তিদের বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, তারা সিঁদুর ব্যবহার করত। অর্থাৎ আর্যদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, তারা ভারতে আসার আগে থেকেই ভারতীয় কৌম সমাজে সিঁদুর ছিল। মন দিয়ে ভ্রমরকে শোনা ছাড়া কিছু করার নেই আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি। ভ্রমর আবার বলা শুরু করল, সিঁদুর বিবাহিতা রমণীদের বশে আনার চিহ্ন নাও হতে পারে।

মনে রাখা দরকার, একমাত্র ভারতের মাটিতেই কায়েম ছিল মাতৃতন্ত্র। সিন্ধু সভ্যতার দেবীমূর্তি তার প্রমাণ দেয়। সারা পৃথিবীতে তখন দেবী সংস্কৃতি চালুই হয়নি। আর্যরা দীর্ঘ কয়েক হাজার বছর ধরে পশ্চিমি পুরুষতন্ত্র ভারতের বুকে কায়েম করতে গিয়ে হেরে পুরাতন মাতৃতন্ত্রের দ্বারস্থ হয়েছিল। তাই তাদের দোষ দিয়ে বিশেষ লাভ নেই। ভ্রমর জানায়, সন্দ ধাতুর সঙ্গে ঊর মিলে সিন্দুর হয়েছে। ‘সিন্ধু’ আর ‘সিন্দুর’ শব্দ দু’টি প্রায় যমজ সেই অর্থে। আবার সিঞ বা সিঙ শব্দ সাঁওতালিতে অত্যন্ত জোরালো। সূর্যকে সিঞ বলা হয়। আবার শঙ্করাচার্য বলছেন, ‘তোমার সিঁথি সরণির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যে সৌন্দর্যরাশি…’ ডিপ্লোম্যাটিক্যালি তিনিও কিন্তু সিঁদুরের সঙ্গে সূর্যের সম্পর্ককে ব্যবহার করেছেন। কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজনায় ভ্রমর মাথা ঝাঁকাতেই সিঁদুর উড়ে এসে পড়ল আমার জামায়। এও তো এক সিঁদুরখেলা।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version