চার

সন্ন্যাসী উপগুপ্তর কথা৷ ‘কাহার নূপুর শিঞ্জিত পদ সহসা বাজিল বক্ষে৷’ সন্ন্যাসী চমকি জাগিল ঠিকই৷ কিন্ত্ত চিকেন পক্সের মারিগুটিকায় তখন তাঁর অবস্থা বেশ খারাপ৷ আর যাই হোক, যতই রুনুঝুনু রবে আভরণ বাজিয়ে বাসবদত্তার এণ্ট্রি হোক না কেন, ‘অভিসার’ করার অবস্হায় ছিলেন না উপগুপ্ত৷ সেবা শুশ্রূষা হল, তাঁর দেহে চন্দন লেপে দেওয়া হল, সবই ঠিক আছে, তা বলে অভিসার! সন্ন্যাসী সুস্হ বোধ করেও বললেন, ‘সময় যেদিন আসিবে সেদিন আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে৷’ থামাও। কিচ্ছু হচ্ছে না। এই সব কাহিনী অজানা নয়। যুগের সঙ্গে মেলাতে হবে তো। কোমরে জড়ানো ওড়না দিয়ে মুখ মুছল। ভ্রমর করছিল বাসবদত্তার চরিত্র। চলছিল ‘অভিসারে’র রিহার্সাল। তাহলে কী হবে? সব জায়গাতেই ভ্রমর লিডার। বলল, একটু অন‌্য কায়দায়, অন‌্য ঢঙে হবে। রবীন্দ্রনাথ যাই বলুন না কেন, আমরা এই উপস্থাপনায় দেখাতে চেয়েছি, উপগুপ্ত বা বাসবদত্তারা বারে বারে এসেছে, যে যার কায়দায় একই জিনিস উপস্থাপিত করেছে। আমরা যদি প্রেমের ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণের প্রেমজ জীবনটাও দূর থেকে দেখি সেখানেও দেখব সব নারীর ভেতর ‘ হা রাধা হা রাধা’ করে বেড়িয়েছেন৷ রাধা যখন চলে যাচ্ছেন, তখন কৃষ্ণ শোনাচ্ছেন তাঁর শেষ অস্ত্র বাঁশির সুর৷ ‘বাঁশুরিয়া বাজাও বাঁশি দেখি না তোমায়’ বলে হা-পিত্যেশ করছেন না রাধা৷ বরং তিনি কৃষ্ণকে বলে যাচ্ছেন, ‘যেখানেই থাকো, আমার পাশে থেকো৷’ এই ‘পাশে থাকো’ কথাটাই কৃষ্ণের মতো কূটনীতিবিদকেও সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে৷ আমরা তো সে তুলনায় কোন ছাড়৷

কোনও প্রেম যদি একবার বলে দেয়, ‘পাশে থেকো’, আমরা সারাজীবন উত্সর্গ করে বসে থাকি৷ আমরা স্পোর্টিং স্পিরিট দেখাতে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ি৷ মদ খাই, সাহস করে বেশ্যাখানায় যাই, হাতের শিরা কেটে ফেলি, আপন মনে বকবক করি কিন্ত্ত ওই ‘পাশে থেকো’, কথাটা থেকে বেরোতে পারি না৷ ভুলে যাই সেই জনপ্রিয় ডায়ালগ৷ ‘হার কর জিতনে ওয়ালোঁ কো বাজিগর ক্যহতে হঁ্যায়৷’ আসলে ভালবাসার, আবেগের লাভের গুড় ভাগ করে খেয়ে নিচ্ছে বাজার৷ রুপোলি হাটের রুপের কেনাবেচায় যতটুকু খেলা, যতটুকু যৌনতা, যতটুকু বিচ্ছিন্নতা, প্রভুত্ববাদ, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই সবই বোধহয় ভায়োলেন্সের যোগফল৷ তাই ছটফটিয়ে উঠল বলে, হারিয়ে গেল কেউ-র মধ্যেই আমরা শখ করে বেঁচে থাকি৷ দুঃখ, সুখ, ব্যথা, বেদনা সব বাইরে থাকে, কিন্ত্ত মশারির বাইরে আমি একা বীরপুঙ্গব৷ কাঠের তলোয়ার সাঁই সাঁই ঘুরিয়ে যাচিছ মাথার উপর৷

একটা সময় পর যখন বাহুবীর্যে, কৌশলে, ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়ে দেওয়ার জন্য মন প্রস্ত্তত হয়, যখন কানে যুদ্ধভেরী বাজতে থাকে অনবরত, তখন অনিবার্যভাবে কানে আসে সেই তিনটি শব্দ ‘আমার পাশে থেকো’৷ ব্যস, তখন এতটাই চুপসে যাই, নেতিয়ে পড়ি, যমেরও অরুচি হয়ে যায়৷ চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সের জন্য বাজার যখন আস্তিন গোটাচ্ছে, তখন একেবারে চুপসে যাওয়া বেলুন৷ যা হওয়ার তাই হয়৷ দুর দুর দুর বলে ঘামে জবজবে মুখের ক্লোজ আপ ছবি তুলেই প্যাক আপ হয়ে যায় শুটিং৷ আসলে প্রেম-রোমান্সও হল একটা প্যাকেজিং৷ নয়তো টাইটানিকের ধবংসের সঙ্গে তলিয়ে যাওয়া বহু মৃত্যুর ইতিহাসকে পণ্য করে বিক্রি করা যায়? সেই বাজার তোমার-আমার লাল-নীল সংসারকে আবেগ আর রোমান্সকে নানা মোড়কে বেচে দেবে, এতে আর আশ্চর্যের কী? বাজার যত চড়া হবে প্রেমের গুড় তত মিষ্টি হবে৷

কিন্ত্ত সুনামি-বিধবস্ত আন্দামানে যে ছেলেটি সমস্ত পরিবারকে হারিয়ে সবুজ ঘাসে ঘাম ঝরিয়ে এক দশক ধরে বেকহ্যামের মতো একটা, হঁ্যা একটা ফ্রি কিক মারার চেষ্টা চালিয়ে যাচেছ, তার কী হবে? বা প্র্যাকটিসের পর ফ্লাড লাইটের আলোয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্র্যাকটিস করে যাওয়া কোনও নামী ক্রিকেটারের কোন কাজে লাগে ভুবনের লগান? বাজারের নিরিখে যেখানে ঠিক হয় গতিপথ, ঠিক হয় অস্তিত্বের লড়াই, সেখানে ‘আমার পাশে থেকো’ শব্দগুচছ নিয়ে বেশি নড়াচড়া করার মানে কি নিউমার্কেটে গিয়ে মুচকুন্দ চাঁপার নোলক খোঁজার  শামিল নয়? বরং ময়দানের তিন উইকেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াও৷ শক্ত গ্রিপ, তীক্ষ্ণ চোখ৷ অপর প্রান্ত থেকে ছুটে আসা বলটাকে লক্ষ্য করে ব্যাট চালাও৷ বলটা ব্যাটের ঠিক মাঝখানে লাগবে তো? তার উপরই যে নির্ভর করছে এই বাজারে বেঁচে থাকা৷ কে ভুলতে পারে, টাইগার পতৌদির কভার ড্রাইভ আর গ্যালারিতে শর্মিলা ঠাকুর? কে ভুলতে পারে, ভিভ রিচার্ডসের স্কোয়ার কাট আর নীনা গুপ্তার হাততালি? “খেলা খেলা সারাবেলা, এ কী খেলা আপনমনে৷” জীবন ঘুরছে চক্রবৃত্তে৷ ভ্রমর যেন সেই রিহার্সালে ওঠাপড়ার বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছিল ফ্রেম বাই ফ্রেম৷

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version