হাইওয়ে চলে গেছে বরাভূম ছাড়িয়ে ঝাড়খণ্ডে তারও ওপাশে। আমি যে বোলেরোটায় চড়ে ছিলাম ওটা থেকে দেখলাম অনেক টিলা এগোলে উরমা স্টেশন ওখানেই একটা পাহাড় গজাবুরু। ওটুকুই আমাদের কাছে পাহাড় সমতলকে হারিয়ে উঁচু হয়ে থাকা। গজাবুরুর মাথায় যে লম্বা শিলাস্তম্ভ দূর থেকে একটা মন্দির চূড়ার আদল আসে। উরমা থেকে বাঁ দিকে ছোট রাস্তায় তিন-চার কিলোমিটার এঁকে বেঁকে কুমারী নদীর বাঁধ ছাড়িয়ে আপাততঃ আমার ক’দিনের বাস মালডিহি গ্রামে। পুরুলিয়ার চটান জমি কিছু নবীন প্রবীণ গাছ খাপড়ার চালের বাড়িঘর কোথাও পাকা। সে হোক আমার থাকার জায়গাটা একটা ঝকঝকে রিসোর্স সেন্টারের দোতলায় চা জলখাবার রাতের খাবারের বন্দোবস্তও পাকা ছৌ দলপতি জগন্নাথ চৌধুরীর বাড়ি থেকে।
গাড়িটা বলরামপুর ছেড়ে বরাবাজার সিন্দ্রি মানবাজার খাতড়া হয়ে রানিবাঁধ যাবে। অনেকটা পথ। বেশীটাই ফাঁকা মাঠ নদী জঙ্গল ঘুরে ঘুরে। টুকরো টুকরো কথাও হচ্ছে একবার গরম চা-ও হলো। গাড়ির ভেতরে সব কথা শোনাও যাচ্ছেনা বাতাস মুছে দিচ্ছে শব্দ কখনও। সামনে বসা মোহনের কাছে ঝুঁকে ওর বাঁশুরিয়া হয়ে ওঠার সময়, ওর অনুশীলন এসব শুনতে চাইছিলাম। ও বলতে থাকে একটু একটু করে প্রেক্ষাপট, গানবাজনার সঙ্গে কিভাবে জমেছিল ওর পিরিত কখন একদিন ফুঁ দিয়েছিল বাঁশের বাঁশিতে দিনমজুরির কায়িক লড়াই এর মাঝেই। লোকের বাড়িতে মুনিষ মেন্দার খাটা,গোবরসার বয়ে নিয়ে বাবুদের জমিতে পৌঁছানোর ফাঁকে ফাঁকে সন্ধেবেলায় গ্রামের পালাপরবে পুজোয় কীর্তন মনসাপালায় বা ঝুমুরের আসরে এমনকি মাইকে বাজা হিন্দি গানের সুর ও কথা তুলে নেওয়া। ওইসব এলোমেলো শিখে নেওয়ার দিন। মোহন বলছিল ওর গানবাজনার নেশা এদিকে ঘরে চরম দারিদ্র। দাদাদের ওসব না-পসন্দ। ওর তবু এ পালা ছেড়ে ও আসরে ছুটে যাওয়ার নেশা শেখার তাগিদ আবার ভাতের জোগাড়ের মহাসংগ্রাম। মোহন সন্ধেবেলায় গ্রামের বন্ধুদের জড়ো করে বসে গায় সুর তোলে। ওর কোনো গুরু নেই ব্যাকরণ জানা নেই সংগীতের স্বরলিপি ও শোনেনি কিন্তু সুর তোলার চেষ্টা ওকে নাস্তানাবুদ করে তুলেছে। পার্টির গণসংগীতে বাজাবে বলে কার এক নেতার যোগাযোগে চলে গেছে ত্রিপুরা। দোর্দণ্ডপ্রতাপ পার্টি থেকে ওর ভাত জোগাড় হয়নি একটা গুমটি বসানোর জায়গা চেয়েছিল গ্রামের রাস্তার ধারে। সেটাও দলাদলিতে এপাশ ওপাশ। অচেনা কলকাতায় মোহন এলো গ্রামের কার কাছে খবর পেয়ে। কলকাতায় এসে যাত্রা অফিসে অপেক্ষা। পুঁজি ওই একটু বাঁশিতে সুর তুলতে পারে। পেট চুই চুই ভাতের পয়সা নেই যে মহানগরে। যাত্রা পার্টির লোকই খাবার খেতে পয়সা দিলো। বিকেলে শিকে ছিঁড়লো মোহনের। যাত্রাপার্টির কাজ। সুরপার্টিতে বসবে। কিন্তু রাতের পর রাত ঘুরে স্বাস্থ্য সায় দেয়নি। ছেড়েছে সে কাজ। আবার ভাতের অকুলান। পানগুমটি খুলে পানবিড়ি করতে গেছে কিন্তু মন ওই পালা বা বাঁশির দিকে। আবার এদিক ওদিক। দোকানের কাঁচামাল বন্ধ থেকে নষ্ট, পুঁজি শেষ। বাজারে সামান্য ধারবাকি। ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে আবার দোকান সাজানোর চেষ্টা। বাঁশিতেও পোক্ত বাতাস খেলছে এতদিনে।
আমাদের গাড়ির পথ অন্ধকারে ডুবে গেছে তখন আর হেডলাইট চিরে ফালা ফালা করছে সড়কের নানান গাড়ি। মোহন বলে যাচ্ছে ওর দিনলিপি।গানবাজনা শেখা বিষয়ে আমার যাবতীয় ধারণা ভাবার অভ্যাস চেনা ছককে মোহন ভেঙে দিচ্ছে চলন্ত খুপরির মধ্যে বসে। আমাদের তখন আর বেশি পথ বাকি নেই পৌঁছতে। ছোট বাজার জনপদ টপকে আমরা খাতড়া বাসস্ট্যান্ড এর কাছে তখন। মোহন নেমে যাবে একটা অন্য গাড়ি ওকে নিয়ে যাবে সারেঙ্গা। আরও ষোলো কিমি উদ্ধার করে আমি আর ফটিক গন্তব্যে ঢুকলাম মাথায় তখনও আমাকে মোহনবাঁশি ওলটপালট দিচ্ছে আমার সব বেসুর কেটে ক্ষীণ সুর আসছে জঙ্গলের হাওয়া ছিঁড়ে।