কিছুদিন ধরেই মেধা এবং ‘নব্বই শতাংশ’র জয়গান শুনছি, তর্ক বিতর্ক, প্রস্তাবনা অনেক কিছুই পড়ে চলেছি। এইসব পড়তে পড়তে আমার নিজের ছাত্রবেলার কথা মনে পড়ে গেল। অতি সাধারণ স্কুলে পড়েছি, এবং খুব সাধারণ মানের পড়াশুনোই করেছি। আমাদের শিক্ষিকারা কোনোদিন আমাদের সাংঘাতিক কোনো স্বপ্ন দেখান নি। হয়তো তাঁরা বুঝেছিলেন এইসব নিম্নবিত্ত মধ্য মেধা ছাত্রীদের দ্বারা এর বেশি হবে না। আশ্চর্যভাবে , এই বোধটা মনের মধ্যে গেঁথে বসলো। এর ওপর ছিল আনন্দবাজারের বিখ্যাত “কি করে তৈরী হচ্ছে ‘অমুক’ স্কুলের ফার্স্ট গার্ল বা বয়।

আজ আমার সেই পনেরো ষোলো বছরের ‘আমি’-র কথা ভাবলে দুঃখ হয়। চাতকের মতো, আনন্দমেলা এলেই, প্রথমেই সেই পাতাটি খুলে সতৃষ্ণ চেয়ে থাকতাম আর তাদের পড়াশুনোর ধরণ, তারা কি পড়ে, কি হতে চায় এইসব পড়ে টড়ে মনে হতো এইসব ভালো ভালো ছেলে মেয়েদের সঙ্গে দৌড়ে পারবো না। স্বপ্ন দেখিনি, ভয় পেয়েছি, হীনমন্যতায় ভুগেছি। বলাই বাহুল্য, তারকা খচিত ফল হয়নি মাধ্যমিকে, তবে বেশ নামি দামি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার মোট নম্বরটুকু ছিল। সেই সম্বল করেই সেই প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছি। তারপর আরও, আরও ভয় আর একরাশ লজ্জা। চোখের সামনে ঘুরছে তারকারা। অনেক মুখই চেনা আনন্দমেলার সৌজন্যে। প্রথম সপ্তাহের পর মন খারাপ করে মাঠে বসে থেকেছি এই ভেবে, যে আমি ‘এদের’ সঙ্গে পেরে উঠবো না। আমার মতো আরও হয়ত অনেকেই ছিল, আমি হয়তো তাদের চিনতাম অথবা চিনতাম না। ক্লাসের পরীক্ষাগুলো যখন শুরু হলো, আর নম্বর আসতে থাকলো, দেখলাম কি আশ্চর্য, আমার নম্বর তো কোনোমতেই কম না! এ কি করে সম্ভব! এরপর আস্তে আস্তে ভাঙা মন জুড়েছে, উদ্যমী হয়েছি, স্বপ্ন দেখেছি, হারতে শিখেছি, হারাতেও পেরেছি। সর্বশ্রেষ্ঠ হতে পারিনি, তাতে কোনো ক্ষোভ ছিল না। নেই।


বহুযুগ আগের কথা এসব। মেধাতন্ত্র এখন যেই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে আমার ভয় হয় তাদের জন্যে যারা তেমন ভাবে বাবা মার বা সকলের মুখ উজ্জ্বল করতে পারেনি, বা পারবেও না। আমার নিজের অভিজ্ঞতা আমি ভুলিনি। যত নম্বরের প্লাবন দেখছি, ততই মনে হচ্ছে কত গুলো ছেলেমানুষ এই নম্বরের প্লাবনে ভেসে গেল, ‘নম্বর’ তেমন হয়নি বলে। কজন বাবা মা বলবেন, “তুমি যা পেরেছো, তাই যথেষ্ট। এরপর দ্যাখো আরও ভালো করতে পারো কিনা।’ পারবেন না। কারণ, তাঁরাও তাঁদের আত্মজদের মত মেধা তন্ত্রের শিকার।তাঁরাও রসগোল্লা খাওয়ানো দেখছেন , রূপকথার মতো সব গল্প পড়ছেন বা দেখছেন। দুঃখ তাঁদের জন্যেও। এই আগ্রাসী হীনমন্যতা থেকে লোভ, হিংসা, অন্যায়, জলের মতো জীবনে ঢুকে পড়বে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। পড়ছেও। আমরা দেখেও দেখছি না। আমরা প্রতি বছর রসগোল্লার ছবি দেখব, ‘নম্বর’ এর পরিসংখ্যান নেবো, এবং একবছরের আমোদ শেষ হলে ‘পরবর্তী’র অপেক্ষায় থাকবো। ‘প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয়’র চক্রে হারিয়ে যাবে শুধু ‘ভালো’ হওয়ার আনন্দ, ছেলেমানুষি আর হুল্লোড়। কারণ, মধ্যমেধার পৃথিবীতে জায়গা নেই। যেন তেন প্রকারেণ জিতিতেই হইবে। যারা জিততে পারবে না, তাদের জন্য বরাদ্দ থাকবে নিরুদ্যম হীনমন্যতা, আর অনেকটা ঈর্ষা, যারা ‘পেরেছে’ তাদের জন্যে। এবং মনোবিকার এবং দুরারোগ্য বিষণ্ণতা। ‘আমি পারবো ‘ বা ‘না পারলেও আমি ভালো থাকবো’ বলতে পারার মতো দুঃসাহস দেখাতে পারবে কয়জন? চোখের ওপর তো ‘রসগোল্লা’! অতএব…।


আমাদের ছোটবেলায় শিক্ষকদের বলা হতো ‘মানুষ গড়ার কারিগর’।‘মানুষের মত মানুষ হও’ এমনটাও শোনা যেতো “once upon a time”। শিক্ষকরা বলতেন, বলতেন বাবা মা-রাও। সেই মনুষ্যত্বের সংজ্ঞা একটু অন্যরকম ছিল বোধহয়।