পর্ব-৩

মীরার জীবনের এই অভিমুখ কি নির্ধারণ করেছিলেন মীরা নিজে, নাকি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, যেখানে নারীর প্রতিভা যতই অসীম হোক না কেন তাঁকে মেনে নিতেই হয় পুরুষের দেখানো পথের  দিশা, অনুসরণ করে এগোতে হয় তাঁরই পদক্ষেপের ছাপ।  শচীন দেবের সাথে দেখা না হলে কেমন হতো মীরার জীবন, জানা নেই এর উত্তর।

এখন বাংলাদেশের দূর্বাঘাসের শিকড়টি জীবনের সন্ধানে চললো পশ্চিমঘাট পর্বতের ঢাল ধরে, আরব সাগরের লোনা হাওয়ায় উড়তে, ভাসতে, ভালবাসার বসত গড়তে।

বোম্বাইয়ে এসে তালিম নিলেন কওয়াস মহম্মদ খানের কাছে। নিজেকে সমৃদ্ধ করার ব্রতে তিনি তখন যেন এক সাধন যোগিনী। ১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া বম্বে থেকে অডিশানে উত্তীর্ণ হয়ে গাইতে থাকলেন ঠুমরী ও গজলের অনুষ্ঠানে। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল তাঁর সেই অনবদ্য সুরের পানসি তরীগুলি?  কেন কেউ সেগুলো সংরক্ষণ করে রাখেনি?  যাঁর স্বামী একজন সুরের মহাসাগরের মহান কাণ্ডারী, তাঁর গান গুলির এহেন অসংরক্ষণজনিত পরিণতি, ভারি দুঃখের, তাই নয় কী?

বম্বে আই পি টি এ-র সঙ্গেও  অনেক গান করেছেন তিনি। বম্বে তখন বাংলাদেশের নক্ষত্রালোকের আলোকচ্ছটার উজ্জ্বলতায় আলোকিত। বম্বের সাংস্কৃতিক জগৎ তখন প্রগতিশীল আবহাওয়ার মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে প্রাণভরে। সেই সময় শান্তি ও নয়াপ্রভাত নামক দুটি নাটকের গান লেখেন মীরা। শচীনদেব এ-র সঙ্গে অনেক গানের রেকর্ডও করেন তিনি। সেগুলির মধ্যে “আজ যো দীপ থে “,” তুমহে বরি চিত্রোঁ, ” কলি পত্রিয়াঁ ছা গ্যয়ে “, “ডালি ডালি ফুল”, “কে দিলো ঘুম ভাঙ্গায়ে”,ইত্যাদি সব বিখ্যাত গান কোথায় হারিয়ে গেছে আজ কালের গর্ভে। সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করে গেছেন নিঃশব্দে শচীনদেবের সাথে, কোত্থাও নাম নেই,  খুব বড় করে তেমন একটা স্বীকৃতি নেই, কী অদ্ভুত তাই না?  কিন্তু সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, সেকালে একমাত্র মীরা দেব বর্মন ছাড়া আর কোনো মহিলা গীতিকার বা সুরকার বম্বের সাংস্কৃতিক জগতে ছিলেন বলে জানা নেই।

এমন একটি বিরল ও উত্তম প্রতিভার প্রতি এই অবিচার কেন তবে?  সে কি কেবল মহিলা বলে?  নাকি তাঁর প্রতিভার আগুনকে ভয় পেয়েছিলেন স্বয়ং শচীনকত্তাও, তাই সামলে রেখেছিলেন এই প্রদীপশিখাটিকে খুব  সন্তর্পণে ও বুদ্ধিবলে নিজের কুলুঙ্গিতে। আঁচটুকু সামলে সযত্নে ব্যবহার করেছিলেন আগুনের পরশমণিটিকে।

অথচ ঘটনা বলছে মীরার উপরে ভীষণ ভাবেই নির্ভরশীল ছিলেন শচীন কত্তা। কোথাও একটা সুর খুঁজে পেয়েছেন হয়তো পথে চলতে চলতে মাঝিদের গানে কিংবা ব্যস্ত শহরের কোনো তালব্যঞ্জক আওয়াজে অমনি বাড়ি ফিরে মীরাকে ফরমাশ করে বসেন সেই সুরে শব্দ বসিয়ে গান বানিয়ে দিতে।

শোন গো দখিন হাওয়া
প্রেম করেছি আমি।
লেগেছে চোখেতে নেশা
দিক ভুলেছি আমি।
শোন গো দখিনো হাওয়া
প্রেম করেছি আমি।।
মনেতে লুকানো ছিল সুপ্ত যে তিয়াসা
জাগিল মধু লগনেতে বাড়ালো পিয়াসা,
উতলা করেছে মোরে, আমারি ভালবাসা
অনুরাগে প্রেম সলিলে ডুব দিয়েছি আমি
শোন গো মধুর হাওয়া প্রেম করেছি আমি।।
দহন বেলাতে আমি, প্রেমের তাপসী
বরষাতে প্রেম ধারা, শরতের শশী,
রচিগো হেমন্তে মায়া, শীতেতে উদাসী
হয়েছি বসন্তে আমি বাসনা বিলাসী।
শোনগো মদির হাওয়া প্রেম করেছি আমি,
লেগেছে চোখেতে নেশা দিক ভুলেছি আমি।।

এই প্রেমঘটিত বিবাহের জন্য ত্রিপুরার রাজ পরিবার একঘরে করেছিল শচীনদেব কে। তাই বুঝি আরও আরও ভালবাসা দিয়ে আঁকড়ে রেখেছিলেন মীরা এই গান পাগল মানুষটিকে। যিনি গানের সুর পেলে নাইতে খেতে অব্দি ভুলে যান, ভুলে যান টাকা পয়সা চাইতেও রেকর্ড কোম্পানির কাছে। তাই সব হিসেব নিকেশ আর সাংসারিক আবর্তের মাঝে ডুবে যায় এতো বিশাল একটি প্রতিভা আপনার মূল্য তুচ্ছ করে। বিখ্যাত স্বামীর সহকর্মী হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে থাকতেই যাঁর মহত্ত্ব ও আনন্দ। যাঁর হৃদয় জুড়ে শচীনদেব আর পঞ্চমের সুর ছন্দ।

যাঁর কলমে ও কন্ঠে এতো আবেগ এতো যৌবন এতো রোমান্স তিনি অক্লেশে তুলে নেন সাংসারিকের আয়ব্যায়ের হিসেবের খাতা, যেখানে লিরিক্সের পাশাপাশি লেখা হতে থাকে ইনকাম ট্যাক্স এর গাণিতিক বাস্তবতা।

হয়তো এটাই আমাদের তৎকালীন ভারতীয় ঐতিহ্য, হয়তো এটাই আমাদের তৎকালীন ভারতীয় নারীর সহজ গৌরবের পথ। কিন্তু এতে করে কী আমরা হারিয়ে ফেলিনি একজন গুণী গায়িকাকে এবং গুণী গীতিকারকে, যাঁর কাছ থেকে আরও আরও অনেক কিছু পাবার ছিল ভারতের সংগীত জগতের? 

এসব নিয়েই আসবো, ভাববো, তর্জমা করে উল্টেপাল্টে দেখবো আলোর নীচে আলোকময়ী আঁধারের উজ্জ্বলতা।

(চলবে)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version