পর্ব- পাঁচ

কী জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইসে৷ তাই আজ যখন প্রিয়বন্ধু হঠাৎ বলে বসে, ‘যদি বলি আজই শেষ রাত্রি’ যারপরনাই চমকে উঠি৷ বুকের ভিতর কয়লাভর্তি উনুনটা ফস করে নিভে যায়৷ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলি৷ মুখ ফসকে বলে ফেলি, কী বলিব হায়, বিচ্ছেদের অনলে পুড়ে কলিজান যায়৷ বোঝানোর চেষ্টা করি এ পিরিতির গাছের শিকড় অনেক গভীরে৷ একে এত সহজে ছিড়তে পারো না৷ মরিয়া হয়ে বলি (সত্যি-মিথ্যের বিচার কে করে!), এতকাল পরে পরিচিত অাঁচল ছেড়ে সাধ্য নেই নতুন কোনও স্কার্টে মুখ ঢেকে নোনাজলে হাবুডুবু খাওয়ার৷ নতুন শরীর খুঁজে পেতে ধুনি জ্বালানো, মোমের শিখার তালে নগ্ন নাচ আর সম্ভব নয়৷ দুঃখ হোক, শোক হোক, পরিচিত হাত ধরেই গিয়ে দাঁড়াতে ইচেছ হয় সাবেকি তুলসীমঞ্চের ধবংসাবশেষের পাড়ে৷ যার ভেতরে প্রাণপণ ঢুঁ মারলেও বেরিয়ে আসবে না কোনও অস্পষ্ট শেকড়৷ অনেকটা ‘আমি একা রইলাম ঘাটে, ভানু যে বসিল পাটে৷’

শেষের কথা বললে কেন জানি না সব ফিরে ফিরে আসে৷ পা হাত ছুড়ে অদৃষ্টকে দোষ দিই, ভগবানে গালমন্দ করি, নিজের থেকে নিজেকে লুকোতে চাই৷ কখনও শান্ত হয়ে বসে ভেবে দেখি না, কেন সম্পর্কের সুরে দুঃখ বাতাস ছড়িয়ে গিয়েছে অগোচরে৷ কেন পা ধুয়ে পুরনো ঘাটে বসে বিকেলের হারমোনিয়ম টেনে নিয়ে বিচ্ছেদের গান গাই? কবির মতো এপিটাফ কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে কেন বলতে পারি না, যত রাত বাড়ে তোমাতে জড়াই৷ কেন টেনিসনের মতো করে কোনও বিচ্ছেদকে ফুত্কারে উড়িয়ে দিয়ে ঘোষণা করতে পারি না, বিচ্ছেদ বেদনাদায়ক হলেও বিচ্ছেদের আগের দিনগুলি চরম আনন্দদায়ক৷ কেন ডাস্টবিন থেকে টেবিল, টেবিল থেকে অ্যাশট্রে, অ্যাশট্রে থেকে টয়লেটের গামছা সর্বত্র কাউকে খুঁজে বেড়াই? কেন কয়লা আর ক্লোরোফর্মের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে গিয়ে একে ওকে টেলিফোন করে বসি? কেন ভাঙা উঠোনের পাশে শ্যাওলাধরা পাঁচিলের গায়ে, ইটে, পুরাতন গাছে হারিয়ে যাওয়া কিছু খুঁজে বেড়াই? কাঁঠালতলায় জ্যোত্স্না দেখে শুনি আবছা হয়ে যাওয়া দিনভর কিচিরমিচির?

ধুস এত প্রশ্নের কী দরকার৷ মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো বাউন্ডুলে৷ সকালে উঠে ফ্রেশ পটি৷ বিজ্ঞের মতো চশমা চোখে খবরের কাগজে বোল্ড রিলেসনের নম্বর টোকা৷ জানতে চাওয়া কেন ওভার ট্রাম হল আমেরিকায়, কেন দু’হাজারে প্রোফাইল পিকচার বদলে ফেললেন জাতির জনক, কেন জমছে না এবারের আইএসএল ইত্যাদি ইত্যাদি৷ বালিশে মুখ গুঁজে শীত্কারের গান শোনার সময় এটা নয় বত্স, বিলাপে সময় নষ্ট বরদাস্ত করবে না জেট যুগের সময়৷ ফাস্ট বেবি ফাস্ট৷ চনমনে রাখার টনিক খেয়ে একেবারে রেসের ঘোড়ার মতো চিঁহিঁ শব্দ তুলে লেজ নাড়িয়ে ছুটতে হবে৷ ওই আকাশের পাহাড়ে ওঠার জন্যই তো তোমার জন্ম, পদস্খলন মানেই তো হেরে যাওয়া৷ সেখানে মিছে এই সব বিলাপে সময় নষ্ট মানায় না৷ সমাজের চাবুক খেয়ে, মরে যেতে যেতেও হয়তো একবার বলার চেষ্টা করবে, পাহাড়ের শেষ বাঁক পেরোলে যে সব নিশ্চুপ, তারপর…৷

তখন তো ভাবতেই হবে কেন একে একে সরে গেল ছোট ছোট রাধা-কৃষ্ণ, কয়েকজন গোপিনী, যমুনাতীর, অসমাপ্ত সব স্মৃতি৷ একবারও কি মনে হবে না, বাস্তবতার ভানে নিজেদের ডুবিয়ে রেখে অন্য কারও থেকে নয়, নিজের থেকেই অবিরাম নিজে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছি৷ এটা-ওটা-সেটা কেজো কথায় মজে থেকে শোনা হয়নি সেই কান্ন্া, ‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে? আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি, পরান বান্ধিবি কেমনে?’ সমাজ শিখিয়েছে শুধু বাঁধতে, বেঁধে রাখতে, জোর করে জাপটে ধরে রাখতে, জোর দেখাতে, অধিকার ফলাতে, আইনের স্বীকৃতি দিয়ে আটকে রাখতে৷ কুসুম, তোর কি কোনও মন নাই রে! মন বারবার হেরেছে৷ বাঁধনের পটিতে চোখ ঢেকে রেখে পরানের খোঁজ করার সময় বা সুযোগ হয় না৷ তাই ঢেউ হতে পারি না আমরা, পাতিহাঁস পায়ে জলকে বাঁধার মতো বোকামি করে বীরপুঙ্গবের মতো এগিয়ে যাই, একটা সময় তলিয়েও যাই৷ প্রয়োজনে, মোহে সোহাগ বাঁধতে চাইলেও অনুরাগের কথা ভেবে দেখিনি৷ সেখানেই বোধহয় বিপত্তির শুরু৷ সেখান থেকেই ভাঙন৷

(শেষ)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version