ভূতের বাড়ি বা ভুতুড়ে বাড়ি তা-ও অনেকে হয়ত দেখেছেন, তার অনেক গা ছমছমে গল্পও চাইলেই অনেকে আপনাকে শুনিয়েও দেবেন নিমেষের মধ্যে, বিশেষ করে যে কোনো এলাকাতেই দু-একটা অন্তত এরকম বাড়ি থাকেই যার সম্পর্কে লোক পরম্পরায় কিন্তু এরকম গল্প কেবল চালুই নেই, একটু খুঁজলে তেমন তেমন লোকের দেখাও মিলে যায় যিনি কিনা আপনাকে সবিস্তারে একেবারে সেসব ঘটনার কিছু আখো দেখা বিবরণ চাইলেই শুনিয়ে দিতে একেবারে যাকে হুজুরে হাজির বলতে যা বোঝায় তা-ই। কালিম্পঙের এরকমই একটি বাড়ির কথা গত এপিসোডে আপনাদের শুনিয়েছি। এ সংখ্যায় চলুন রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে পাড়ি জমানো যাক সুদূর কেরালায়। এবং কেবল তা-ই বা বলছি কেন, কেরালায় এবার আমরা যেখানকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে চলেছি সেখানে ঘটনা আবার আরো রোমহর্ষক। সেখানে অশরীরীর অস্তিত্ব তো আছেই (অন্তত গল্পের খাতিরে আছে) সেইসঙ্গে গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে অতীতের শ্যাওলা মেখে জড়িয়ে রয়েছে খানিকটা স্বদেশী যুগের অনুষঙ্গও।

দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত কেরল রাজ্যের ১৪ টি জেলার একটি জেলা ওয়েনাদ৷ কেরলের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত এই জেলাটির জেলা সদর কালপেট্টা। গোটা জেলাটি পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উচ্চভূমি অঞ্চলে অবস্থিত। ১৯৮০-র ২ নভেম্বর কেরালার ১২ তম জেলা হিসেবে পূর্বতন কালিকট এবং কণ্ণুরের কিছু তালুক নিয়ে নতুন ওয়েনাদের জন্ম। জেলাটির একটা বড় অংশই ঘন জঙ্গলে আচ্ছন্ন। এবং এটি কেরালার বনবিভাগের রক্ষণাধীন। ওয়েনাদ জেলায় রয়েছে তিনটি পুরসভা, এগুলি হল—কালপেট্টা, মানন্তবাড়ি এবং সুলতান বতেরি। যেটা মনে রাখতে হবে আলাদা করে তা হল, এই অঞ্চলে আগেও যেমন ছিল এখনো তেমনি একাধিক জনজাতির বসবাস।

থামারাসেরি ঘাট পাস হল ওয়েনাদের একটি ট্যুরিস্ট স্পট।পশ্চিমঘাট পর্বতমালার এই গিরিপথ স্থানীয় মানুষের কাছে পরিচিত থামারাসেরি চূড়ম নামে। এরকম নাম কেন? না, মালয়ালম ভাষায় চূড়ম মানে হল গিরিপথ। এই থেকেই এরকম নাম। লোকে বলে এই গিরিপথটিই নাকি আদ্যন্ত ভুতুড়ে। কীরকম? আসুন শোনা যাক সেই কাহিনি।

তখন ভারতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ আমল। ওয়েনাদে আসার এই রাস্তা তখন আরো বিপদসংকুল। বিশেষ করে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চেনা অত সহজ নয়। তখনো এলাকায় বিভিন্ন জনজাতির বাস।এখানে আসার পথ কেবল তাঁরাই ভালো জানেন। এরকমই এক জনজাতির মানুষ কারিন্থান্ডান। ছেলেবেলা থেকেই এই অঞ্চলে ঘোরাফেরা করতে করতে পথ একেবারেই তাঁর নখদর্পণে। ভারতে তখন রেলপথ বসানোর কাজ চলছে। রেল কোম্পানির কর্তাদের নাওয়া-খাওয়া-ঘুম উড়ে গেছে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে চষে ফেলতে হচ্ছে গোটা দেশ। এরকমই এক ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার তখন ওয়েনাদের চার্জে। কেবল পথ খুঁজে বার করাই নয়, সবথেকে ছোট রুটে কীভাবে ওয়েনাদে পৌঁছনো যায় সেই রাস্তাও খুঁজে বার করার দায়িত্ব পড়েছে তাঁর ঘাড়ে। কয়েকজন ডাকাবুকো সায়েব হাল ছেড়ে ফেরত যাবার পর এই সায়েবের ওপরেই এখন সব দায়িত্ব। ইনিও ব্যর্থ হলে আপাতত বোধহয় চাপাই পড়ে যাবে এই অঞ্চলে রেলপথের কাজ। পরে আবার নাহয় দেখা যাবে কী করে কী করা যায়।

ইঞ্জিনিয়ার সায়েবেরও এদেশে কম দিন হয়নি। সাত ঘাটের জল খেয়ে রেল কোম্পানিতে এই পদে আসায় মাথায় বুদ্ধি যেমন খেলে বদ বুদ্ধিও নেহাৎ কম খেলে না। ভদ্রলোক করিন্থান্ডানকে খুঁজে পেতে এনে তাঁকেই দিলেন পথ বাৎলানোর কাজ। করিন্থান্ডানের তো ব্যাপারটা বাঁ হাতের খেলা। রাস্তা বেরোল তো বটে কিন্তু কার সাহায্যে বেরোল সেটা বলে দিলে তো সব কৃতিত্ব হাত ছাড়া হয়ে যায়। কোম্পানি মোটা পুরস্কার দেবে তো বটেই সেই সঙ্গে সম্মানের বিষয়টাও নেই তা নয়। ইঞ্জিনিয়ার সায়েব অনেক মাথা খাটিয়ে ঠিক করলেন করিন্থান্ডানকে সরিয়ে দিতে হবে, তাহলেই রাস্তা ফাঁকা। কী করা যায় কী করা যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় খেলে গেল, লোকটাকে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দিলেই তো হয়। এই তো অখাদ্য দেশ। তার ওপর লোকটা তো জনজাতির। বাঘ সিঙ্গিকে থোড়াই করে বটে, পাহাড়ি রাস্তাঘাটও হাতের তালুর মতো চেনে, কিন্তু সায়েব মেম দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটাই যা বাকি থাকে! ফলে ঝুলিয়ে দিলে কে আর দেখতে আসছে! যে কথা সেই কাজ।

রেল পথ তো বসল। সায়েবও দেশে ফিরে গেলেন। কিন্তু করিন্থান্ডানের রাগ পড়ল না। এলাকায় যাকে বাগে পান ভয় দেখিয়ে তারই প্রাণ খাঁচাছাড়া করে ছাড়েন। লোকের তো প্রাণ ওষ্ঠাগত। কী করা যায়, কী করা যায়! এবার ডাক পড়ল এক স্থানীয় পুরুতের। কী, না এই উৎপাত থেকে যে করে হোক মুক্তি চাই। পুরুতবাবাজী এলেন। এসে অনেক মন্তর-তন্তরও করলেন, কিন্তু কোথায় কী! শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে করিন্থান্ডানের বিদেহী আত্মাকে ওয়েনাদের সবথেকে উঁচু জায়গা লাক্কিডিতে একটা গাছের সঙ্গে চেন দিয়ে বেঁধে ফেললেন।

ব্যবস্থা তো একটা হল। করিন্থান্ডানের আত্মার আর তো লোককে ভয় দেখানোর উপায়ও নেই। কিন্তু অদ্ভুত যেটা তা হল সেই থেকে আজ অব্দি গাছটি যেমন বড় হয়েছে তার গায়ে বাঁধা শিকলটিও তেমনই বড় হয়েছে।

তারপর থেকে মানুষ লাক্কিডির এক জায়গায় দূর থেকে চেনে বাঁধা গাছটাকে দেখতে পান। সেই কবে থেকে এখানে যাঁরা আসেন এই গাছটাকে না দেখে তাঁরা কেউ যেমন ওয়েনাদ ছাড়েন না, তেমনিই স্থানীয়রাও প্রত্যেক বছর মার্চ মাসের দ্বিতীয় রবিবার করিন্থান্ডান স্মৃতি র‍্যালি বার করে এখানকার প্রথম শহীদকে সম্মান দেখাতে ভোলেন না। তবে হ্যাঁ, সন্ধ্যের পর লাক্কিডির পথ ধরে যদি বা কেউ আসতে বাধ্যও হন তাহলেও গাছটির দিকে চোখ তুলে তাকাবেন? কেন, তাঁর ঘাড়ে মাথা আছে কটা, শুনি একবার!!

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version