উচ্চতা একটু কম হলে তাকে আমরা বাইট্টা বলে ঠাট্টা করি। মেক্সিকোতে বাইট্টা না বলে বলা হয় ‘চাপো’। অবশ্য চাপো বলে খুব বেশিদিন ঠাট্টা করা যায়নি কারণ, একদিন এই শব্দটাই মেক্সিকোর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক শব্দ হয়ে দাঁড়ায়। জোয়াকিম আল গুজমেন লয়েরা; উচ্চতা কম হওয়ায় তাকে বলা হত এল চাপো। শুরুতে তিনি ছিলেন আর দশটা ড্রাগ লর্ডদের কর্মীর মধ্যে একজন। কাজ করতেন ড্রাগ লর্ড মিগুয়েল অ্যাঞ্জেলের অধীনে। ছেলের এই কাজ নিয়ে তাঁর বাবা সবসময় বলতেন, ‘তুই সারা জীবন ড্রাগ লর্ডদের কর্মী হয়েই থাকবি। কখনো ড্রাগ লর্ড হতে পারবি না’।বাবার এই কথার জেদ ধরেই জোয়াকিম গুজমেন একদিন হয়ে ওঠে সিনোলোয়া কার্টেলের ড্রাগ লর্ড। মেক্সিকো থেকে শুরু করে আমেরিকা সবার নজর পড়ে বিখ্যাত সেই ড্রাগ লর্ড এল চাপোর দিকে।এল চাপো মেক্সিকোতে গ্রেফতার হন; একবার নয়, দু’বার। কিন্তু মেক্সিকোর মেক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন থেকে দু’বারই তিনি পালান। কীভাবে?
আমেরিকার সঙ্গে মেক্সিকোর যখন এক্সট্রাডিশনের চুক্তি হয়, তখন এল চাপো সিদ্ধান্ত নেন, তাঁকে জেল থেকে পালাতে হবে। ইতিমধ্যে মেক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন “লা পালমা”-এর গার্ডদের ঘুষ দিয়ে সে ড্রাগ বিজনেস থেকে শুরু করে লাক্সারি জীবন- সবই মেক্মাম সিকিউরিটি প্রিজনে করছিলো। কিন্তু, যখন মেক্সিকোর সঙ্গে আমেরিকার এক্সট্রাডিশনের চুক্তি হয়, তখন তার জেলখানার সুখের জীবনের অবসান ঘটে, কারণ তখন তাঁকে আমেরিকার জেলেই থাকতে হয়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এল চাপো তখন জেলখানার গার্ডদের ঘুষ দিয়ে লন্ড্রি কার্টে করে পালিয়ে যায়। বলা হয়, পালানোর জন্য তাঁর ২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়। কিন্তু পরে জানা যায়, এল চাপো সেই লন্ড্রি কার্টেই ছিলেন না। আসল ঘটনা চাপোর পালিয়ে যাওয়া তদন্ত করতে যে নিরাপত্তা বাহিনী আসে, তাদের ইউনিফর্ম পরেই এল চাপো মেক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন থেকে পালায়। অর্থ্যাৎ, এল চাপোর স্কেপে যে ২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়, তা শুধু প্রিজনের কর্মীদের পাশাপাশি মেক্সিকান গভার্মেন্টের অনেকের পকেটেই গিয়েছিল।
প্রথম বার পালানোর পর দ্বিতীয় বার প্রিজনে এল চাপোর খুব একটা সুবিধা হয়নি। এল চাপোর ব্যাপারে সেবার সবাই খুব সাবধান, কেননা আগের বারের মতো মেক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন থেকে এল চাপো পালিয়ে গেলে, মেক্সিকোর মান-সম্মান বলতে আর কিছুই থাকবে না। তাই, তাকে এক প্রিজনে বেশিদিন না রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু, এল চাপোর পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম। জেলখানার কাছাকাছি সে একটি জায়গা কিনে নেয়। সেখানে তাঁর লোকেরা দিনের পর দিন মাটি খুঁড়ে সুরঙ্গ বানাতে থাকে। যদিও সুরঙ্গ বানালেও খুব সুবিধার নয়, কারণ প্রিজন কর্তৃপক্ষ টের পেলেই এল চাপোকে অন্য জেলখানায় পাঠিয়ে দেবে। তাই অত্যাধুনিক মাটি খোঁড়ার জিনিসপত্র ব্যবহার নয়, পুরনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলো; যাতে খুব একটা শব্দ না হয়। এদিকে পুরনো যন্ত্রপাতিতে কাজ করতে যেমন অসুবিধে হচ্ছিল, তেমনি কাজও তাড়াতাড়ি হচ্ছিল না। এই ভাবেই টানা পরিশ্রমের পর অবশেষে এল চাপোর প্রিজনের শাওয়ারের জায়গার পাশে সুরঙ্গ বানানো শেষ হয়। সেই সুরঙ্গ দিয়েই এল চাপো মেক্সিমাম প্রিজন থেকে পালায়। মাদক সাম্রাজ্যে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে বলে আঁচ পেলেই তাকে সরিয়ে দেওয়াই ছিল ‘এল চাপো’র মাদকচক্র ‘সিনালোয়া কার্টেল’-এর দস্তুর। সেখানে শত্রুকে গুলি করে মেরে দেহ টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ছড়িয়ে দেওয়া তো অতি সাধারণ ঘটনা। কখনও কখনও প্রমাণ না রাখতে চাইলে শত্রুর গুলিবিদ্ধ দেহ বা জীবন্ত অবস্থাতেই বাঘের মুখে ফেলে দেওয়াটা ছিল লিট্ল চাপোর শখ! সব শত্রুকে একেবারে প্রাণে না মেরে তিলে তিলে অত্যাচার করে মারা হত। যেমন- পেশির মধ্যে বটল ওপেনার ঢুকিয়ে দিয়ে মাংস বার করে আনা, আর তার উপর ছড়িয়ে দেওয়া হত লঙ্কাগুঁড়ো, অথবা দগদগে ক্ষতে, নাকের মধ্যে লঙ্কার গুঁড়ো ঢুকিয়ে দেওয়া হত, সেই সঙ্গে বিদ্যুতের শক, জলে চুবিয়ে রাখার মতো অত্যাচার তো ছিলই।
পাশাপাশি করাত দিয়ে গলা কাটা তো ছিলই, উগো হার্নান্দেজের মুখের চামড়া তুলে তা ফুটবলের সঙ্গে সেলাই করে দিয়েছিল এল চাপো নিজে! শত্রুদের ড্রামের মধ্যে ঢুকিয়ে গরম জলে ফোটানো, আগুন ধরিয়ে দেওয়া বা বাঘ-সিংহ দিয়ে খাওয়ানো— এ সবই এই অন্ধকার জগতের দস্তুর। মেক্সিকোয় কাজের অভাব রয়েছে বলেই অনেকে এই সব মাদকচক্রের হয়ে কাজ করতে বাধ্য হন, আর তাঁদের মধ্যে অনেকের খোঁজ মেলে না কোনও দিন। তবে মাদকের গুদামে কাজ করাও সহজ নয়। মাদকের প্যাকিং, মিক্সিং চলে যে সব গোপন ডেরায়, সেখানে পুরুষ হোক বা মহিলা, সকলেরই ড্রেস কোড এক— নগ্নতা! কর্মীর শরীরে কোনও পোশাক থাকা চলবে না! কারণ, মাদকের ব্যবসায় বিশ্বাসের কোনও জায়গা নেই। যদি কোনও কর্মী পোশাকের আড়ালে মাদক বাইরে নিয়ে গিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে? এই আশঙ্কাতেই নগ্নতার ফতোয়া। তাতেও শান্তি নেই। প্রতিদিন কাজের শেষে মহিলাদের গোপনাঙ্গে অস্বস্তিকর তল্লাশি চলত। মহিলা কর্মীরা গোপনাঙ্গে মাদক লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিনা, এটা নিশ্চিত হলে তবেই মিলত ছুটি।
দু’বার মেক্সিমাম প্রিজন থেকে পালানোর পর মেক্সিকোর সরকার এল চাপোকে হন্য হয়ে খুঁজতে খুঁজতে এল চাপোকে খুঁজে বের করে। এবার আর এল চাপো পালাতে পারেনি। মেক্সিকান সরকার এবার আর কোনো ঝুঁকি না নিয়ে চাপোকে আমেরিকাতে পাঠিয়ে দেয়। আর সেখানেই মেক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজনে কাটে তাঁর বাকী জীবন। ইতিহাসের পাতায় এল চাপো যত বড় ড্রাগ ডিলার গ্রামের বাড়িতে কিন্তু সে রীতিমতো সুপারহিরো। যদিও মেক্সিকান মোস্ট পাওয়ারফুলদের মাধ্যে এল চাপো একজন। সেই হিসেবে সে সুপারহিরো হতেই পারে। তবে দেখার বিষয় মেক্সিকান মেক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন থেকে দু’বার পালিয়ে যাওয়া এল চাপো আমেরিকার মেক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন থেকে পালাতে পারেনি। মেক্সিকোর মাদক দুনিয়ার বেতাজ বাদশা জোয়াকুইন গুজম্যান ওরফে ‘এল চাপো’ ২০১৯ সালে ধরা পড়ে কলোরাডোর জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড খাটছে। কিন্তু তাঁর রাজত্ব থেমে নেই। তাঁর তিন ছেলে বাবার অনুপস্থিতিতে সামলাচ্ছে মাদক-সাম্রাজ্য।