তাহলে কী জীবন নিয়তির খুব কাছে চলে এলো? এ প্রশ্ন সবার মধ্যেই কোনো একটা সময় উঁকি দিতে থাকে। এসবই মানুষের নিরন্তর আর অনন্ত সময় ধরে জিজ্ঞাসা অন্য কোনো প্রাণীর তো নেই তাই বিরাট প্রাণীজগতে কেবল মানুষেরই সংকট। সবসময় সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিজের উপস্থিতি টের পায়। তার যে পরিসমাপ্তির ভয়। কী অসংখ্য আর বিরাট জীবের সংসারে মানুষই পেয়েছে এক দারুন স্বাদ যা তারিয়ে তারিয়ে কত হাজার বছর ধরে দিব্যি ভোগ করছে দলে দলে আর কেটে পড়তে হচ্ছে টাইমটুকু পার করে। সবাইকে বশ করে পরাজিত করে নিজের শ্রেষ্ঠ সংস্থানটুকু তৈরি করে নিয়েছে। তবু তার নিয়তির ভয় অন্তিম রুখে দেওয়ার আমরণ চেষ্টা। এগুলো নিয়েই মানুষ জীবনের পরম পাওয়া আর সমস্যাও। তার দায় আছে যে। কত বছর ধরে সে দুনিয়াদারি করতে করতে পুরোনো হয়ে গেলো। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা আছে তারই। শ্রেষ্ঠত্ব পেলো সে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে। তা সেসব থাক। এখন যেটা মনে হচ্ছে সেটাই বরং বেটে নিই।
নিজের দাম চুকাতে চুকাতে আজ আমি অনেকটা দূর। সেটা বেশ টের পাচ্ছি। নিজেকে নিয়ে বসেছি। এখন আমার চারপাশে সবকিছু দাঁড়িয়ে থাকলেও শুধু নিজেকে দেখতে পাচ্ছি অন্ততঃ ভানহীন অকপট। সে নিজেই উগরে দিচ্ছে। পেছনে ফিরে দেখছি কখনও বা। যেটা সত্যি এযাবৎ আমার আচমকা পাওয়া জীবনের সঞ্চয়টুকুর কাছে কোথাও ঝাঁপিয়ে পড়িনি আমি বরং ভুল পথঘাট ধরেই হেঁটেছি বাঁচিয়ে রেখেছি তাও প্রায় গতিহীন। যদিবা চলতে গিয়ে জ্যোৎস্নাও এসেছে কিন্তু অদৃশ্যপ্রায় সে আলো তবু আমার গায়ে সামান্য হলেও কোথাও না কোথাও পড়েছে নিশ্চই।…আমি ছাড়তে শিখলাম না যদি হেরে গিয়ে ফৌত হয়ে যাই সে ভয় কী কম। গুঁতো দিয়ে যাচ্ছি জানিনা যাবো কোথায়। আলোটুকু খুঁজছি ছাদ খুঁজছি ঘুম আহার সবটাই আমার চাই। একা হতে চাইনা মানুষ চাই আড্ডা চাই কুয়াশা পার করে সকাল একটা চকচকে। দূরের সিগন্যাল দেখতে চাইনা বরং জানালায় প্রতিনিয়ত দৃশ্যের বদল চাই। কোনো ঘোলাটে স্মৃতিতে ফিরতে আমার ইদানিং কষ্ট হয় হয়তো ফেরার উপায়ও নেই। তবু আবার আমার জয়গাবদলের আমিই দর্শক। আমি একা।
আজ কোথাও যেন নিজের লুকোনো দখলদারিতে ভাসান এসে আমাকে তুলে এনেছে অন্য জমিতে। দূর আড়ালে থেকে কেউ আমাকে লক্ষ রাখছে নিশ্চয়। নিয়তি মানেন? -এ প্রশ্নের উত্তর নেই হলফ করে বলতে পারি কারোর নেই শুধু শব্দটাকে স্বীকার আর অস্বীকার করা ছাড়া।
ভালো সময় আমার কিছুতেই স্থায়ী হয়না। সারাদিন যা কিছু করি সেগুলো জড়ো করলে নিঙড়িয়ে কোনো মাল বেরোবার নয়। সকালে বোকার মতো গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকি ফ্যালফ্যাল করে ভাবি কতো পাতা ঝরে গেছে আরও কতো নতুন গজালো। ঈশ্বর প্রতিদিন কী প্রোডাকটিভ টসটস করছে লক্ষণভোগ আমগুলো ওপরের ডালে। কাকের আহার ওই গাছের সেরাগুলো। এদিকে আমি নানা দুর্নীতির চর্চায় দিব্যি দিন মাস কাল কাটিয়ে দিচ্ছি। খেউড়-এর ঢেউ গুনছি। বই ক’খানা টেবিলেই পড়ে থাকে কখনো ঝোলায় ভরে ঘরবার করি টেক্সট এর অন্দরে জুলিয়ান সোরেল এখন সেমিনারিস্টদের, প্রিফেক্টদের মধ্যে কোন উলঝানে জড়ালো সে সুতোটা হারিয়ে ফেলেছি। কিম্বা অনাথকে বুঝে উঠতে পারিনা ঈশ্বরীতলায় ওর আসল মতলবটা কী।
আজ আবার সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো দশ মিনিট চা-টা ঠান্ডা। মুখ আর মেজাজ বিগড়ে গেলো, উপায় নেই বগা তোমার এখন কঠিন আশ্রমবাস। বাসিনি সরেন সকালেই দায় সেরে ক’কাপ বানিয়ে কাজ সেরে রেখেছে অগত্যা ওই পাচন আমাকে নিতে হলো। ওহ ভুলে গেছি আমিই তো আদতে কিছুদিন প্রিফেক্ট! গম্ভীর ডিসিপ্লিন বর্তানোই আমার আপাততো দায়িত্ব আমার নিজের সারাজীবনের ক্যাচালসমৃদ্ধ জীবনের রুটিন বদলাতে বদলাতে আমি হাওয়া মোরগ নজর রেখেছি চোরা চাহনিতে। ডিসিপ্লিন! যে এ শব্দটার ঠিক সমার্থক কী হতে পারে নিজেই বুঝিনি। মুড়ি ঘুঘনি খেলাম তখন ন’টা পঁচিশ। কমিউনিটি নাস্তা। বেলা চাপলে সাইকেল একটা নিলাম কিন্তু বহু আপত্তি সত্ত্বেও। চাকায় টাল ব্রেকের বালাই নেই বল্লভপুরডাঙ্গার গড়ানটাতে নামতে গিয়ে বেজায় বিপত্তি ব্রেকহীন গড়িয়ে চলেছি সামনে বাঁকে থামার উপায় নেই সোজাসুজি ঝোড়ে ঢুকতে ঢুকতে সামলে নিলাম। পাকা খেলোয়াড় কী না। এমনি নয় পাক্কা পঁয়তাল্লিশ বছরের দু’চাকার সার্টিফিকেট আছে আমার।
প্রথম বন্ধু শুভদ্রর জাওয়া মোটরসাইকেলে চপ্পল আর পায়জামা ছিঁড়ে খালে পড়তে পড়তে …সে কী বিরাট ট্যাকল মাইরি তখন আঠেরো হয়নি। পুরোনো গপ্পোটা এসেই যায় এখন তো সাইকেল নিয়ে বিপত্তির ঘটনাটা বলতে চাইছিলাম। তা আচমকা ওই সাইকেল ঠেঙিয়ে ল্যাডলিদার আখড়ায় লোহার গেট খোলার হিসেব লাগাচ্ছি বাগান কেয়ারি সদরের মাথায় সেজে আছে যে। ঠেলে ঢুকলাম। এ আখড়ায় অনেকদিন পর। এখন কালেভদ্রে দেখা কথা হয় আমরা নব্বই-এর সহচর। দিবারাত্রি থাকতাম চষে বেড়াতাম কলকাতার নানান ঠিকানায় তখন ওদের কাগজের বাঘ অতীত হয়ে গেছে আমি সেসব জড়িয়ে মড়িয়ে দেখিনি দূর ফুটপাথ ঘেঁষে উঁকি দেওয়া সেই সম্ভার দেখেছিলাম তখন কলেজ তখন কবিতা। বড় বুড়িয়ে গেলাম গো তাও মাত্র একটাই জীবন।
মনের দু’কথা কই গরম চা আর ঝড়ের বেগে পেডাস্টালের হাওয়া। সময় ফুরিয়ে যায় জলদি যা আমি কোনদিনই চাইনি আমরা কেউই চাইনি। ক্যানালের উল্টোপাড় ঘেঁষে ঢালের উঁচুনিচু চটান মাটি ফুঁড়ে ইউক্যালিপটাস সোনাঝুরির বনের ভিতরে ভিতরে এক একটা অস্পষ্ট আশ্রয়ের দেওয়ালে রিসর্টের হাতছানি আমি যেখানে বসে রাত্রির জ্যোৎস্না দেখবো বলে আকাঙ্ক্ষা করেছি মনে মনে সেসব আজ এখন ম্লান লাগছে। কেন জানিনা। মোহমুক্তি? কেনো? আমি প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে এগোচ্ছি হঠাৎ চেন পিছনের গিয়ারের ঘাটের বাইরে বেরিয়ে গেলো। সাইকেল থেকে নেমে হাত কালি করলাম মার্কামারা বিকল সাইকেল ঠেলে একমাইল হেঁটে আশ্রমের ডেরায় সিঁধালাম। আঃ ফ্যানের নিচে চেয়ারটা টেনে একটু জিরোই। ঠান্ডা জলের বোতলটার দিকে হাত বাড়িয়েও সামলে নিলাম। কিছুদিন সর্দিগর্মিতে গলাটা ভালো নেই। সুরহীনতার এক অসুখ। আমিই বুঝি।