মেয়েবেলায় যে পাড়ায় থাকতাম, সেখানে জনৈক কার্তিক নামের লোক ছিল। তাকে সবাই ডাকত ‘ধেড়ে কার্তিক ‘ বলে। তার সেই শিরোপা – কে সে নিজেও মেনে নিয়েছিল, কেউ ওই নামে ডাকলেই নির্বিকারে সাড়া দিত।’কেন’ জিজ্ঞেস করার চিরকেলে বদভ্যাসে পড়শিদের মুখে শুনেছিলাম লোকটা আইবুড়ো, তার ওপর তার ‘স্বভাব চরিত্তির’ নাকি ভাল না। এইসব বিশেষণের উৎস কিন্তু কার্তিকেয়, আমাদের কার্তিক ঠাকুর। কিন্তু কেন!

নিঃসন্তান দম্পতির বাড়ি রাতের অন্ধকারে যে ঠাকুর ফেলে আসার চল্ রয়েছে, সে আইবুড়ো, তাও না হয় বুঝলাম, কিন্তু বাকিটা! এইতো কিছুদিন আগেই মা’য়ের সঙ্গে ঘুরে গেল, দিব্যি শান্তশিষ্ট, কোনো গায়ে পড়া ভাব দেখিনি। তাছাড়া, কোন্ দেবতার স্বভাব চরিত্র একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা! কেচ্ছা কেলেঙ্কারিতে কেউ কম নয়।যত বদনাম কার্তিকের – ‘মাছ খায় সবাই, দোষ হয় মাছরাঙার’! যাক্ গে, নিন্দুকের কথায় কান দিতে নেই।

অবশ্য বাংলাভাষী অঞ্চলে সর্বজনীন পুজোর লিস্টে কার্তিক বাদ পড়ায় সাধারণ মানুষের ক্ষণিকের স্বস্তি, নইলে বিলবই হাতে ছেলের দল চাঁদা তুলতে বেরুত। আরেক বিড়ম্বনা বিলে লেখার পর্ব, নামের বানানের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। এই জ্বালায় নামের প্রথম অক্ষরই বলি, কিন্তু একবার ‘মুখোপাধ্যায় ‘ বলে ফেলে তার যা করুণ পরিণতি হয়েছিল, কহতব্য নয়- ‘মুখেপাদ্দেয়’!

কার্তিকের প্রচুর নাম, তার মধ্যে ‘স্কন্দ’ খুব পরিচিত। মহাভারতে তিনি ব্রহ্মার বড় ছেলে সনৎকুমার। ব্রহ্মার ইচ্ছায় দেবসেনাপতিত্বে নিযুক্ত। পুরাণে শিবের পাশুপতি তনুর নাম অগ্নি, তাঁর পত্নী স্বাহা- তাঁদের ছেলে স্কন্দ। মহাভারতে দেখা যায়, ব্রহ্মা কার্তিকের সঙ্গে দেবসেনার বিয়ে স্থির করেন। বৌদ্ধ ও জৈন পুরাণে তিনি ময়ূরবাহন। এমন একজন এলিজিবল্ ব্যাচেলর দেবসেনাকে বিয়ে করেছিলেন, না চিরকুমার ছিলেন, সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

ব্রহ্ম পুরাণে কার্তিককে মুনিপত্নীদের সাথে ব্যাভিচাররত উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির যুবকরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। অগ্নির ঔরসে যার জন্ম, তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অস্বাভাবিক নয়। ঠিক সেই কারণেই কী ‘স্বভাব চরিত্তির খারাপ ‘ তকমা! একই কারণে মূর্তিমান তেজবীর্য কার্তিকের আরাধনা সন্তানলাভের আকাঙ্ক্ষায়, লোকায়ত বিশ্বাসে।সম্ভবত গণিকালয়ে কার্তিকপুজোর প্রাচীন পরম্পরায় অমিত পৌরুষের সেই একই ধারণা প্রবহমান।।