বাউল গানের সুরে ও প্রথা মেনে হয় জয়দেবের মেলা। বীরভূম জেলার ইলামবাজার থানার এলাকায়, অজয় নদের পাশেই, এই গ্রাম। গ্রামের নাম কেন্দুবিল্ব হলেও বেশিরভাগ লোকের মুখে তা কেঁদুলি। এখন অবশ্য জয়দেব কেঁদুলি বা শুধুমাত্র জয়দেব নামেও পরিচিত এই গ্রাম। এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন গীতগোবিন্দ রচয়িতা কবি জয়দেব। মকর সংক্রান্তির দিনে, তার তিরোধান দিবস পালিত হয় এই এলাকায়। সেই দিবস মেলার আকার ধারণ করেছে।
সর্বধর্ম সমন্বয় এই জয়দেব কেন্দুলি মেলা মানুষকে নতুন করে বাঁচার রসদ যোগায় বলে দাবি করেন কার্তিক দাস বাউল। তিনি বলেন সারা বছর পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বাউল গান শোনানোর জন্য ডাক আসে আমরা যাই মানুষের দাবি মেনে বাউল গান শোনাতে কিন্তু জয়দেব মেলা থেকে ডাক আসে না তবুও সারা বছর ভারতবর্ষের সমস্ত বাউল ফকির অপেক্ষায় থাকি কবে মকর সংক্রান্তি আসবে কবে হাতে একতারা নিয়ে গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ গাইতে গাইতে পৌঁছাব জয়দেব কেন্দুলি মেলা। পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র যেখানে সমস্ত ধর্মের মানুষ এসে জমায়েত করে কড়া পাকের শীতের রাতে বাউলের আখড়ায় মানুষ ভুলে যায় জাত ধর্ম হিংসা হানাহানি। অহংকার শুধু একটাই কথা মনে আসে যা ভাষার মাধ্যমে বাউলের সুরে মুখ দিয়ে ফুটে ওঠে জীবন ও ভালোবাসা।
মুঘল যুগে জয়দেব কেন্দুলি সেনপাহাড়ি পরগণার অন্তর্গত ছিল। ঔরঙ্গজেব দ্বারা জারি করা একটি ফরমানের পর সপ্রদশ শতাব্দীতে এই পরগণা বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণরাম রায়ের অধিকারভুক্ত হয়। এই গ্রামের যুগলকিশোর মুখোপাধ্যায় বর্ধমান রাজদরবারের সভাকবি ছিলেন। মনে করা হয়ে থাকে, তার অনুরোধে বর্ধমানের মহারাণী ব্রজকিশোরী ১৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রামে জয়দেবের জন্মভিটেয় রাধাবিনোদ মন্দির স্থাপন করেন। ১৮৬০-এর দশকে নির্বাক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের রাধারমণ ব্রজবাসী এই গ্রামে তাদের কুলগুরু জয়দেবের জন্মভিটেয় নির্বাক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাধাবল্লভ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।
সংস্কৃত সাহিত্য এবং সঙ্গীত শাস্ত্রে জয়দেবের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি। যৌবনে সন্ন্যাস নেওয়ার ইচ্ছেয় নীলাচলের পথে অগ্রসর হন। কিন্তু সন্ন্যাস নেওয়া আর হয় না। পদ্মাবতীকে বিয়ে করে সংসারে বাঁধা পড়তে হয় তাঁকে। জয়দেবের স্ত্রী-ভাগ্য ভাল। পদ্মাবতীকে সাধন-সঙ্গিনী হিসেবেই পেয়েছিলেন তিনি। সংসারে থেকেও পদ্মাবতীকে নিয়েই সাধনকর্মে রত হন জয়দেব। জয়দেবের সাধনার নাম ‘পরকীয়া সাধনা’। এ পথের অধিকার কেবল নিষ্কাম ভক্তের। জয়দেবের জীবনের মূলমন্ত্র ছিল কৃষ্ণপ্রেম। স্বকীয়া রমণী পদ্মাবতীকে পরকীয়া ভাবে সাধনায় চিরসময় পরমপুরুষের দিব্যানুভূতি লাভ করেন তিনি। জয়দেবের সাধনচিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে।