ছত্তিশগড়ের খনিজসমৃদ্ধ বস্তার এখন কার্যত যুদ্ধক্ষেত্র। নিরাপত্তা বাহিনী কয়েক হাজার সৈন্য সেখানে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে মাওবাদীদের সমূলে নির্মূল করা যায়। সরকারি ভাষ্যে অনুযায়ী এই অভিযান মাওবাদী নিঃশেষ অপারেশন। কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তারা মাওবাদীদের প্রায় সাবার করে ফেলেছে। কিন্তু বহু মানবাধিকার কর্মী ও বিশ্লেষক বলছেন, আসলে এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করে খনিজ সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টামাত্র। কার্যত বস্তার অঞ্চল ভারতের অন্যতম খনিজসমৃদ্ধ অঞ্চল, যেখানে প্রচুর পরিমাণে লৌহ আকরিক, কয়লা, বক্সাইট ইত্যাদি মজুদ রয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে যত লৌহ আকরিক মজুদ আছে তার ১৯ শতাংশ রয়েছে ছত্তিশগড়ে। আর তার একটি বড় অংশ রয়েছে বস্তারে। খনিজ সম্পদে ছত্তিশগড় দেশের মধ্যে দ্বিতীয় হলেও সেখানে দারিদ্রতার হার ৮০%। বস্তার অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ আদিবাসী এবং তফসিলি উপজাতি। সরকার খনি এবং উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের জমি কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করলে হাজার হাজার আদিবাসী বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় সংগঠিত হতে থাকে, ফলত অঞ্চলটি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আদিবাসীদের ভূমির অধিকারচ্যুতির বিরুদ্ধে, খনি কোম্পানি, পুলিশ ক্যাম্প এবং রাষ্ট্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগঠিত করতে মাওবাদীরা সাহায্যের হাত বাড়ায়।

২০২২ সালে যে নতুন অরণ্য সংরক্ষণ বিধি করা হয় তাতে বলা হল কেন্দ্র অনুমতি দিলে গ্রামসভার অনুমতি ছাড়াই বেসরকারি সংস্থা বন কাটতে পারবে। তার কিছুদিন পরেই কেন্দ্রীয় বন, পরিবেশ ও জলবায়ু দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে সংসদে জানিয়ে দিলেন, বিগত তিন বছরে ৫৫৪.৩ বর্গ কিমি বনভূমি খনি-রাস্তা-সেচ প্রকল্পে বদলে ফেলা হয়েছে। অথচ ২০০৬ সালে সংসদে পাশ হওয়া বন আইনে জঙ্গলের উপর আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃত হয়, বসবাসের, গবাদি পশু চরানোর, বনজ সম্পদ ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং গোষ্ঠীগত স্বত্ব তৈরি হয়। এমনকি বলা হয়, আরণ্যক গ্রামবাসীর গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া জমির চরিত্র বদল করা যাবে না। ২০২৪ সালে বিজেপি ফের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছত্তিশগড়ে মাওবাদী দমনে ‘অপারেশন জিরো টলারেন্স’ নামে জোরালো অভিযান শুরু হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালেই ২০০-এর বেশি মাওবাদী নিহত হয়েছে। মাওবাদীদের প্রধান ঘাঁটি বলে পরিচিত বস্তারে ৩২০টিরও বেশি নিরাপত্তা শিবির স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে প্রতিটি শিবিরে ১৫০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন রয়েছে। এছাড়াও, এই অভিযানে ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বাধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি। নিরাপত্তা বাহিনী দাবি করছে, এই প্রযুক্তি তাদের অভিযানকে আরও কার্যকর করছে এবং প্রতিদিন মাওবাদী সাবার হচ্ছে।

আসলে এই অভিযান কেবল নিরাপত্তা নয়, এটি সম্পদ দখলের একটি রণকৌশল। বস্তারের ৫১টি খনিজ ইজারার মধ্যে ৩৬টি বেসরকারি সংস্থার হাতে রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আর্সেলর মিত্তলের মতো আন্তর্জাতিক কর্পোরেট গোষ্ঠী। প্রাক্তন বিধায়ক মণীশ কুঞ্জম বলেন, ‘আসল লক্ষ্য খনিজ সম্পদ। সরকার নিরাপত্তার অজুহাতে আদিবাসীদের সরিয়ে দিচ্ছে, যাতে কর্পোরেটরা নির্বিঘ্নে খনন করতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০০৫ সালে যখন টাটা ও এসার খনিজ উত্তোলনের চেষ্টা করেছিল, তখন আদিবাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এখন সেই প্রতিরোধকে দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করা হচ্ছে।’ সালওয়া জুদুমও ছিল মাওবাদী দমনের নামে ব্যাপক গ্রাম উচ্ছেদ, হত্যা ও ধর্ষণ। যে কারণে সর্বোচ্চ আদালত ২০১১ সালে সালওয়া জুদুমকে অবৈধ ঘোষণা করে। আজ ‘নতুন নাম ও রূপে সেই একই নীতি ফের বাস্তবায়িত হচ্ছে।’

ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণু দেও সাই দাবি করেছেন, ‘খনি প্রকল্প ও শিল্পায়নের মাধ্যমে আদিবাসীদের জীবন উন্নত হবে। ছত্তিশগড় খনিজ রাজস্বের দিক থেকে ভারতের দ্বিতীয় রাজ্য, এবং এই খাত থেকে রাজস্ব দ্রুত বাড়ছে।’ কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এই অঞ্চলে শিশু মৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি, এবং স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পানীয় জলের মতো মৌলিক চাহিদার সংকট প্রকট। বস্তারে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৮০%। কংগ্রেসের মুখপাত্র সুশীল আনন্দ শুক্লার বক্তব্য, ‘আজ বস্তার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। আদিবাসীদের উচ্ছেদের বিনিময়ে রাজস্ব অর্জনের পরিকল্পনা অসাংবিধানিক ও অমানবিক।’ আদিবাসীরা বারবার বলেছেন, তাদের মূল লড়াই জমি, বন ও জল রক্ষার জন্য। সংবিধানের পঞ্চম তফসিল অনুযায়ী, আদিবাসী এলাকার জমি, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের জন্য গ্রাম পরিষদের অনুমতি প্রয়োজন। কিন্তু সরকার বারবার এই নিয়ম অমান্য করে আদিবাসীদের ভূখণ্ডকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিয়েছে। বর্তমান সরকারের অভিযানে কেবল রক্ত ঝড়ছে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই অভিযান কি আদিবাসীদের জন্য নিরাপত্তা আনছে, তাঁরা কি তাঁদের জমি জঙ্গল ফিরে পাচ্ছে নাকি তাঁদের জীবন আরও হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে?
